দায়িত্ব অবহেলায় লেভেলক্রসিংয়ে বেড়ে চলছে মৃত্যু

প্রকাশিত: ২৯ জানুয়ারী, ২০২২ ১২:৩৬:১৬

দায়িত্ব অবহেলায় লেভেলক্রসিংয়ে বেড়ে চলছে মৃত্যু

ঘন কুয়াশার আড়ালে আলো ফুটতেই ঝরে গেল চার প্রাণ। বাসা থেকে ওই চার নারী বের হয়েছিলেন কাজে যাবেন বলে। তাদের নির্মম মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে রইল নীলফামারীর রেললাইন। জেলা সদরের দারোয়ানি রেলস্টেশনের কাছের একটি লেভেলক্রসিং অটোরিকশায় পার হওয়ার সময় গত বুধবার (২৬ জানুয়ারি) ঘটে দুর্ঘটনা।

এই নীলফামারীতেই গত ৮ ডিসেম্বর অরক্ষিত রেললাইনে খেলায় মেতেছিল তিন শিশু। সেদিন ট্রেনে কাটা পড়ে ওই তিন ভাই-বোনসহ চারজনের মৃত্যু হয়। মাত্র চার দিন আগে সোমবারের কথা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্টেশনের কাছে আলীনগর হাজির মোড় নামক জায়গায় অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় নছিমনে থাকা তিনজনের মৃত্যু হয়।

ট্রেনের কাটা পড়ে এমন মৃত্যু যেন নিত্যদিনের খবরে পরিণত হয়েছে। চলতি বছরে গতকাল পর্যন্ত ২৬ দিনে ১৪টি দুর্ঘটনায় ২৭ জন মারা গেছে। অরক্ষিত রেলপথ, অবৈধ লেভেলক্রসিং, বৈধ লেভেলক্রসিংয়ে গেটম্যানের অভাব এবং চলাচলকারীদের অসচেতনতাকেই দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে লেভেলক্রসিংয়ে কতসংখ্যক দুর্ঘটনা হচ্ছে, তার আলাদা কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। পরিসংখ্যান বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, মূলত ট্রেন চলার সময় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলতে লেভেলক্রসিংয়ের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়। তিনি বলেন, ট্রেন চলাচলের ক্ষেত্রে লেভেলক্রসিংয়েই বেশির ভাগ সময় ট্রেন বাধার সম্মুখীন হয়। সড়কের গাড়ি রেললাইনে উঠে যায়। এতে দুর্ঘটনা ঘটে।

রেলওয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ৮০টি রেল দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৭২টি দুর্ঘটনায় ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। আর সাতবার ট্রেন চলার সময় বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ২.৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর ৩৫ শতাংশ দুর্ঘটনা মানুষের ভুলের জন্য হয়েছে।

২০০৯ সাল থেকে ১২ বছরে রেললাইনে দুই হাজার ৬০১টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ট্রেনের চলার পথে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার দুর্ঘটনা হয়েছে ২৫৮ বার। এসব দুর্ঘটনায় ৩৪৩ জন মারা গেছে। দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ট্রেনের যাত্রী ৩২ জন এবং রেলের কর্মরত ৪৩ জন। অথচ রেল দুর্ঘটনার কারণে ট্রেনের বাইরে সড়কে মৃত্যু হয়েছে ২৬৮ জনে। অর্থাৎ রেল দুর্ঘটনায় ট্রেনে যত মানুষ মারা যায় তার থেকে অন্তত সাড়ে তিন গুণ বেশি মানুষ মারা যায় সড়কের দুর্ঘটনায়।

কেন ঘটছে এসব দুর্ঘটনা, প্রতিকারের উপায় কী—এসব প্রশ্নে রেল কর্তৃপক্ষের কেউ সরাসরি কথা বলতে রাজি হয়নি। লেভেলক্রসিংয়ের দায়িত্ব রয়েছে অবকাঠামো বিভাগের হাতে। এই বিভাগের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কামরুল আহসান বলেন, ‘আমার কথা বলা নিষেধ আছে। ডিজির সঙ্গে কথা বলেন। ’

রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ (ডিএন) মজুমদার কোনো কথা বলতে রাজি হননি।  , ‘এ বিষয়ে এখন কোনো কথা বলব না। ’ রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে রেলওয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, নিয়মিত দুর্ঘটনার কারণে এটা নিয়ে রেলের সংশ্লিষ্টরা বিব্রত। তাই হয়তো কেউ কথা বলতে চাচ্ছে না। তবে সত্যি বলতে, এসব দুর্ঘটনায় রেলকে কিন্তু দায়ী করা যাবে না। এই কথাগুলো সত্য হলেও প্রকাশ্যে বললে কেউ ভালোভাবে নেবে না।

তিনি আরো বলেন, ট্রেন কিন্তু নিজের লাইনেই চলে। এমন তো কখনো হয়নি ট্রেন রাস্তায় উঠে গাড়ি চাপা দিয়েছে। রেললাইনে সড়কের গাড়ি উঠে যাওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটে। এখন দেশের পুরো রেললাইনকে তো আর কাঁটাতারে ঘিরে ফেলা সম্ভব নয়। আর অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ের দায়িত্ব তো রেল নেবে না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে রেলপথে ৯৭৪ দুর্ঘটনায় এক হাজার ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে ১১৬টি হয়েছে লেভেলক্রসিংয়ে। এই ১১৬ দুর্ঘটনায় ১৭৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। রেল দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে এক হাজার তিনজন। লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার কারণে ৩১৪ জন আহত হয়েছে।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে তিন হাজার কিলোমিটার রেলপথে থাকা তিন হাজার ৩৯৮টি ক্রসিংয়ের মধ্যে এক হাজার ৩৬১টি অবৈধ। আর বৈধ-অবৈধ ক্রসিংয়ের মধ্যে অরক্ষিত দুই হাজার ৫৪টি। অবৈধ ক্রসিংয়ের বেশির ভাগেই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) রাস্তা।

এআরআইয়ের গবেষণার তথ্য বলছে, দেশের মোট অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ ও এলজিইডির রাস্তা রয়েছে ৪২৭টি, সড়ক ও জনপথ বিভাগের ২৪, পৌরসভার ১১০, সিটি করপোরেশনের ৩২, একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের রয়েছে ২৭, জেলা পরিষদের ১৩ ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তিনটি। এ ছাড়া ১২৭টি ক্রসিং কার আওতায় আছে, তা জানা যায়নি।

দুর্ঘটনার কারণ ও সমাধান প্রসঙ্গে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হাদিউজ্জামান  গণমাধ্যমকে  বলেন, মূলত অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ের কারণেই রেলপথে দুর্ঘটনায় মৃত্যু বাড়ছে। দুর্ঘটনা কমাতে হলে রেল গেটগুলোকে বৈধ করতে হবে। সেখানে সব সময় গেটম্যান থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। শীতে ঘন কুয়াশায় দুর্ঘটনা বেশি হয়।

তিনি বলেন, শীতকালে ট্রেনের লোকোমোটিভে (ইঞ্জিনে) ছোট ছোট অনেক বাতি যুক্ত করতে হবে যেন আলো অনেক বেড়ে যায়। সড়ক আর রেলপথ সমান পর্যায়ে থাকলে এতে রেললাইনে গাড়ি আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে, এতে দুর্ঘটনা কম হবে। সব কিছুর পরও মানুষের সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।


প্রজন্মনিউজ২৪/আল-নোমান

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ