প্রধান অভিযুক্ত আটক, তৃতীয় পক্ষকে সন্দেহ

প্রকাশিত: ২২ অক্টোবর, ২০২১ ০২:৪৯:৩১

প্রধান অভিযুক্ত আটক, তৃতীয় পক্ষকে সন্দেহ

কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনায় তৃতীয় পক্ষের প্ররোচনা থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো। প্রচার হওয়া দুটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, এক যুবক রাতে পূজামণ্ডপের কাছের একটি মাজারের মসজিদ থেকে কোরআন শরিফ এনে মণ্ডপে রাখছেন। এ রকম একজনকে গত রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত এলাকা থেকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। কক্সবাজার পুলিশ বলছে, কুমিল্লায় ভিডিও ফুটেজে দেখা ওই ব্যক্তিই আটক ব্যক্তি। তবে  কুমিল্লা পুলিশ সেটা নিশ্চিত করবে।

ঘটনাস্থলের কাছের দুটি বাড়ির ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ দেখে ‘প্রধান সন্দেহভাজনকে’ শনাক্ত করার কথা জানিয়ে পুলিশ বলেছে, তাঁকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ওই ব্যক্তির নাম জানায়নি পুলিশ। অবশ্য পুলিশ সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে এরই মধ্যে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে তাঁর নাম এসেছে। ইকবাল হোসেন (৩২) নামের ওই যুবক নগরীর ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের দ্বিতীয় মুরাদপুর-লস্করপুকুর (সুজানগর) এলাকার মাছ ব্যবসায়ী নূর আহম্মদ ওরফে আলমের ছেলে।

কুমিল্লা জেলার পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ রকম একজনকে কক্সবাজারে আটক করা হয়েছে। আমাদের টিম সেখানে যাচ্ছে। আটক ব্যক্তিকে কুমিল্লায় এনে যাচাই-বাছাই করে জানানো হবে।’

গত ১৩ অক্টোবর মহাষ্টমীর দিন কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পারে অস্থায়ীভাবে তৈরি করা পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন পাওয়া যায়। পরে একদল লোক কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে ওই মণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর চালায়। ওই ঘটনার পর চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে পূজামণ্ডপ-মন্দিরে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সেখানে মারা যায় পাঁচজন। এরপর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনীসহ বেশ কয়েকটি স্থানে পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। চৌমুহনীতে মারা যায় দুজন।

গত বুধবার রাতে কুমিল্লার ঘটনার ‘প্রধান সন্দেহভাজনকে’ চিহ্নিত করার বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন জেলার পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ। তিনি বলেছেন, পুলিশের একাধিক সংস্থার তদন্তে এই ঘটনার অগ্রগতি হয়েছে। সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ঘটনার আগের ১২ অক্টোবর রাত আড়াইটা পর্যন্ত মন্দিরে লোকজনের উপস্থিতি ছিল। পরদিন সকাল সাড়ে ৬টার দিকে দুজন নারীভক্ত মণ্ডপে এসে হনুমানের মূর্তির ওপর প্রথম কোরআন শরিফ দেখতে পান। রাত আড়াইটা থেকে সকাল সাড়ে ৬টার মধ্যে কোনো একসময় সেখানে কোরআন রেখে যাওয়া হয়েছে। এ সময় হনুমানের হাতের গদাটি নিয়ে গেছেন ওই ব্যক্তি।

পুলিশ সূত্রের দাবি, এ ঘটনার দুটি সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া গেছে। যার একটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ‘প্রধান সন্দেহভাজন’ পূজামণ্ডপের কাছের শাহ আবদুল্লাহ গাজীপুরীর (রহ.) মাজার মসজিদ থেকে কোরআন শরিফটি নিয়ে মণ্ডপের দিকে রওনা হন। ফুটেজে তখন সময় দেখাচ্ছিল রাত ২টা ১০ মিনিট। মাজার থেকে মণ্ডপ পর্যন্ত হেঁটে যেতে সময় লাগে দুই থেকে তিন মিনিট। এই ফুটেজটি মাজারের সামনের পুকুরের বিপরীত পাশের একটি বাড়ির ক্যামেরার। পুকুরটি লিজ নিয়ে ওই বাড়ির মালিক মাছ চাষ করেন। যাতে মাছ চুরি না হয়, সে জন্য তিনি সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছেন।

দারোগাবাড়ি মাজার নামেই নগরবাসীর কাছে মাজারটি পরিচিত। মাজারের মসজিদের বারান্দায় তিলাওয়াতের জন্য রাখা থাকে বেশ কয়েকটি কোরআন শরিফ।

আরেকটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, মণ্ডপে পূজার থিম হিসেবে রাখা হনুমানের মূর্তির ওপর কোরআন রেখে অভিযুক্ত ব্যক্তি ফিরে আসছেন। তাঁর কাঁধে গদা। ফুটেজে তখন সময় দেখাচ্ছিল রাত সোয়া ৩টার মতো। এই সিসি ক্যামেরাটি মণ্ডপের কাছের আরেকটি বাড়ির।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর একটি সূত্রের দাবি, দারোগাবাড়ি মাজার মসজিদে নিয়মিত যাওয়া ইকবালসহ তিনজন ঘটনায় সরাসরি জড়িত। অন্য দুজন হলেন হুমায়ুন কবির (২৫) ও ইকরাম হোসেন (৩০)। তাঁরা নানুয়ার দীঘির পাড়ের আশপাশের বাসিন্দা। এই দুজনকে আটক করা হয়েছে। ইকবালকে গ্রেপ্তারের পর তাঁদের পেছনে আরো কেউ আছে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। এর আগে ফয়েজ আহমেদ নামের আরেকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যিনি ফেসবুকে ঘটনাটি লাইভ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মামলাটি তদন্ত করছে।

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ইকরাম ১৩ অক্টোবর সকাল ৬টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে জাতীয় জরুরি সেবার হেল্পডেস্ক নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করেন। এরপর কোতোয়ালি থানার ওসি আনওয়ারুল আজিম ঘটনাস্থলে ছুটে যান। সাড়ে ৬টার দিকে তিনি কোরআন শরিফ উদ্ধারের পাশাপাশি ইকরামকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে থানায় নিয়ে যান।

কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) এম তানভীর আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফুটেজগুলো ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো বিশ্লেষণ করেই সন্দেহভাজনকে শনাক্ত করা হয়েছে।’

এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দুটি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে। মাজার থেকে কোরআন নিয়ে বের হওয়ার ফুটেজটি এক মিনিট ১০ সেকেন্ডের। আর মূর্তির ওপর কোরআন রেখে গদা কাঁধে করে চলে যাওয়ার ফুটেজটি ৪২ সেকেন্ডের।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বলছেন, সিসিটিভি ক্যামেরা তো স্থির থাকে, কিভাবে এটি চারদিকে ঘুরল?

গতকাল বিষয়টি জানতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, দারোগাবাড়ি মাজারের পূর্ব পাশে একটি পুকুর রয়েছে। আর পুকুরের পূর্ব পারের একটি বাড়িতে লাগানো রয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। বাড়িটি মো. সাইদুর রহমানের। তিনি লাকসামের দৌলতগঞ্জ শাখা সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার। কয়েক বছর ধরে তিনি ওই পুকুর ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করছেন। মাছ চুরি ঠেকাতে বাড়ির দোতলার বারান্দায় তিনটি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়েছেন। এর মধ্যে একটি ক্যামেরা চারদিকে ঘুরে দৃশ্য ধারণ করতে পারে বলে সাইদুর রহমানের স্ত্রী কোহিনুর আক্তার জানিয়েছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, পূজামণ্ডপের ঘটনার পর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) লোকজন এসে ফুটেজসহ ক্যামেরাটির সব সরঞ্জাম নিয়ে গেছেন। কয়েক দিনের মধ্যে সব কিছু ফেরত দেবেন বলে জানিয়ে গেছেন।

দারোগাবাড়ি জামে মসজিদের পেশ ইমাম ইয়াছিন বলেন, ‘আমরা তো বুঝতে পারিনি, কেউ এখান থেকে কোরআন শরিফ নিয়ে এমন কাজ করবে।’

প্রধান সন্দেহভাজনকে চিহ্নিত করার বিবরণ দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, কুমিল্লার ঘটনা যে লোকটি করেছে, ক্যামেরার মাধ্যমে তাকে চিহ্নিত করা গেছে। যে মাজারের সঙ্গে মসজিদ, দেখা গেছে সেই মসজিদে রাত ৩টার দিকে সে গেছে। একবার নয় তিনবার গেছে।

গতকাল সচিবালয়ে বল প্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের (রোহিঙ্গা) সমন্বয়, ব্যবস্থাপনা ও আইন-শৃঙ্খলা সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এ কথা বলেন।

আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞ টিম দীর্ঘক্ষণ এটা বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হয়েছে। এই ব্যক্তি মসজিদ থেকে কোরআন শরিফটি এনে রেখেছে, সেটা তারই কর্ম। রেখে সে মূর্তির গদাটি কাঁধে করে নিয়ে এসেছে, সেই দৃশ্যটিও আপনারা দেখেছেন।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এই লোকটি (ইকবাল) কার প্ররোচনায়, কার নির্দেশে, কিভাবে এই কর্মটি করল...সেই কাজটি পরিকল্পনামাফিক করল। দুই-তিনবার যাওয়া-আসার মধ্যে সে এই কর্মটি শেষ করেছে। কাজেই এটি নির্দেশিত হয়ে কিংবা কারো প্ররোচনা ছাড়া করেছে বলে আমরা এখনো মনে করি না। তাকে ধরতে পারলে বাকি সব উদ্ধার করতে পারব বলে বিশ্বাস করি।’

দুর্গাপূজার মধ্যে কুমিল্লার মণ্ডপে ‘কোরআন রাখা’ কোনো ভবঘুরের কাজ নয় বলে মন্তব্য করেছেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। তিনি বলেছেন, এ ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত। চক্রান্তকারীরা এর পেছনে আছে। তাদের বের করে আনার দায়িত্ব এখন রাষ্ট্র ও সরকারকে নিতে হবে। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নেতা এই আইনজীবী গতকাল চট্টগ্রামে নিজ বাসায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ দাবি জানান।

পরিবার ও স্থানীয় কাউন্সিলরের দাবি : সন্দেহভাজন ইকবালের মা বিবি আমেনা বেগম সাংবাদিকদের বলেছেন, তাঁর তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে ইকবাল সবার বড়। তাঁর ছেলে ১৫ বছর বয়স থেকেই নেশা করা শুরু করেন। নেশা করে পরিবারের সদস্যদের ওপর অত্যাচার করতেন, রাস্তাঘাটেও নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়াতেন। তিনি বিভিন্ন মাজারেও ঘুরে বেড়ান। দারোগাবাড়িসহ কুমিল্লার বিভিন্ন মাজারে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ইকবালের ছোট ভাই রায়হান মিয়ার দাবি, তাঁর ভাইয়ের বোধবুদ্ধি কম। নেশার টাকার জন্য তিনি যেকোনো কাজ করতে পারেন; যার কারণে কারো প্ররোচনায় এমন কাজ করে থাকতে পারেন বলে ধারণা করছেন তাঁরা।

ইকবাল ইয়াবা সেবন করতেন দাবি করে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ মোহাম্মদ সোহেল বলেন, তিনি আগে  নির্মাণশ্রমিকের কাজ করতেন। কিছুদিন মদিনা পরিবহনের বাসে হেলপার হিসেবেও কাজ করেছেন। ইকবাল কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নন। তাঁর ধারণা, তৃতীয় কোনো পক্ষ ইকবালকে ব্যবহার করেছে।

প্রজন্মনিউজ২৪/আল-নোমান

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ