শতশত স্থাপন বসতভিটা বিলীন  তিস্তার ভাঙনে 

প্রকাশিত: ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১১:১১:৪৭

 শতশত স্থাপন বসতভিটা বিলীন  তিস্তার ভাঙনে 

 প্রজন্মনিউজ ডেস্কঃ দীর্ঘ দিন ধরে অব্যাহত রয়েছে তিস্তার ভাঙন। এরই মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে গেছে কুড়িগ্রামের রাজারহাটের ঘড়িয়ালডাঙ্গা, বিদ্যানন্দ ও ছিনাই ইউনিয়নের শত শত পরিবারের বসতভিটা। বাদ যায়নি ভিটেমাটি, ফসলি জমি, স্কুল, মসজিদ, সেতু, কালভার্ট, বাঁধ, সড়কসহ স্পার। সব হারিয়ে দিশেহারা এসব এলাকার মানুষজন।
রাজার হাটের ভাঙন কবলিত এলাকাগুলো ঘুরে দেখা যায় এমন চিত্র।


জানা যায়, দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে ভেঙেই চলেছে তিস্তা নদী। রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের খিতাব খাঁ মৌজা, গতিয়াসাম মৌজা, বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের রামহরি ও তৈয়ব খা এলাকা, ছিনাই ইউনিয়নের কিং ছিনাই, কালুয়া, জয়কুমর, ছিনাইহাট সহ পূর্ব দেবত্তর এলাকার শত শত পরিবারের বাড়ি-ঘর সহ বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তীব্র ভাঙনের শিকার হয়ে তিনটি ইউনিয়নের প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা। এতে নদীতে তলিয়ে গেছে চারটি মসজিদ, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি সেতু, পাঁচটি কালভার্ট, বাঁধ, এক কিলোমিটার পাকা সড়কসহ দুটি স্পার।


এসব এলাকা ঘুরে জানা যায়, নদী ভাঙনে তিস্তার পেটে গেছে অন্তত একশ বিঘা জমির রোপা আমনের ক্ষেত। হুমকির মুখে রয়েছে তিন ইউনিয়নের তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কয়েকটি মসজিদ, একটি গুচ্ছ গ্রাম, এক কিলোমিটার পাকা সড়ক সহ শত শত পরিবারের বসতভিটা। ভাঙনের শিকার মানুষজন তাদের বাড়ি ঘরের টিনের চাল, টিনের বেড়াসহ পাকা ভবন ভেঙে সেগুলো রেখেছেন বিভিন্ন রাস্তার ধারে। অধিকাংশ পরিবার তাদের সদস্যদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে।


গতিয়াসাম মৌজার গৃহবধূ লিলি বেগমের অভিযোগ, ‘যখন তিস্তার ভাঙন আমাদের বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে ছিল, তখন থেকেই অনেক সাংবাদিক এসেছে। তাদের অনেক কথা বলেছি, অনেক বক্তব্য দিয়েছি। কিন্তু কেউ গুরুত্ব সহকারে বিষয়টি তুলে ধরেনি। এখন কথা না বলাটাই ভালো। এতো কথা বলে লাভ কি? আমরা আজও অসহায়, কালও অসহায়। আমাদের এখানে চেয়ারম্যান, মেম্বার কেউ আসে নাই। পানি উন্নয়ন বোর্ডও কোন উদ্যোগ নেয় না। এখন পর্যন্ত আমার দুই একর জমি নদীগর্ভে গেছে। বাড়ি ঘর ভেঙে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি।’

একই অভিযোগ করে গতিয়াসাম মৌজার কৃষক নজীব হোসেন (৭৫) বলেন, ‘গত কোরবানির ঈদের আগ থেকে তিস্তা নদী ভাঙছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বা কোন জনপ্রতিনিধি এই নদী ভাঙন এলাকায় আসলো না। কোনো জনপ্রতিনিধি এসে সহায়তা দেওয়া তো দূরের কথা সান্ত্বনাও দিলো না।’

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শ্রী রবীন্দ্রনাথ কর্মকার বলেন, ‘আমি একাধিকবার সরেজমিনে নদী ভাঙন কবলিত এলাকাগুলো দেখতে গিয়েছি। নদী ভাঙনের শিকার পরিবারগুলোকে নগদ টাকা, শুকনো খাবারসহ অন্যান্য সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রেখেছি।’


তিস্তার ভাঙ্গনে ভিটেমাটি হারানো খিতাব খাঁ মৌজার গৃহবধূ আঞ্জুয়ারা (৪৫) বলেন, ‘এখানে আমাদের তিন রুমের পাকা বাড়ি ছিল। বাড়ি-ঘর ভেঙে নিয়ে বোনের বাড়িতে রেখেছি। আমাদের আশ্রয় নেওয়ার কোন স্থান নেই। ঋনের টাকায় ১২ শতক জায়গা কিনেছিলাম। এখনো রেজিস্ট্রি করিনি। কোনো কিছু চাষও করলাম না। তার মাঝেই তিস্তার ভাঙনে সম্পূর্ণ জমি নদীতে চলে গেল।’

একই পরিস্থিতির শিকার রামহরি এলাকার গৃহবধূ আসমা বেগম (৫০) বলেন, ‘এখানেই আমার পাকা বাড়ি ছিল। নদী ভাঙনের শিকার হওয়ায় সে বাড়ি ভেঙে ইটসহ অন্যান্য জিনিসপত্র আত্মীয়ের বাড়িতে রেখেছি। আপাতত এখানে রান্না ঘরটা আছে সেটাতে ছেলের বউ ও ছেলে থাকে। আমি অন্যের বাড়িতে গিয়ে থাকি। আমাদের মোট জমির মধ্যে অবশিষ্ট আছে আনুমানিক বিশ শতক। নদীর ভাঙনে চলে গেছে আনুমানিক ত্রিশ শতক জমি।’


অন্যদিকে তিস্তার ভাঙনে দিশেহারা মানুষজন ভাঙন ঠেকাতে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিতে একাধিকবার মানববন্ধন করেছেন। মানববন্ধনে অংশ নেওয়া বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ জানান, শুধু গতিয়াশাম এলাকায় কয়েকদিনে প্রায় দুই হাজারের বেশি ঘর নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভাঙন দুর্গতদের পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা দেওয়ার জরুরি। মহাপরিকল্পনার নামে অথবা ভিন্ন নামে হলেও অন্য দেশের ঋণের ওপর নির্ভর না করে দেশীয় অর্থায়নে তিস্তা নদীর সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে জানান তিনি।


কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, তিস্তা নদীর ভাঙন রোধ এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য প্রায় ৮২০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এটি বাস্তবায়ন হলেও তিস্তা নদীর ভাঙন রোধে স্থায়ীভাবে সমস্যা সমাধান হবে। বর্তমানে অস্থায়ীভাবে জিও ব্যাগ এবং জিও টিউব দিয়ে তিস্তার ভাঙনরোধের চেষ্টা চলছে।

রাজারহাট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সজিবুল করিম জানান, এরই মধ্যে খিতাব খা মৌজার নদী ভাঙনের শিকার ৩৫০টি পরিবারকে শুকনো খাবার ও দুই হাজার টাকা করে সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। রামহরি ও তৈয়ব এলাকার ২৩টি পরিবারকে তিন হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও কিং ছিনাই, কালুয়া, জয়কুমর, ছিনাইহাট সহ পূর্ব দেবত্তর এলাকার নদী ভাঙনের শিকার ১২২টি পরিবারকে শুকনো খাবার সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

 

 


প্রজন্মনিউজ২৪/ইমরুল


 

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন





ব্রেকিং নিউজ