প্রকাশিত: ০১ অগাস্ট, ২০২১ ০১:২০:২৪ || পরিবর্তিত: ০১ অগাস্ট, ২০২১ ০১:২০:২৪
একাত্তরে তখন উত্তাল বাংলাদেশ। গণহত্যা, ধর্ষণসহ নানা ধরনের নিপীড়ন চালাচ্ছে বর্বর পাকিস্তানি হানাদাররা। তাদের মার্কিন সরকার দিয়ে যাচ্ছে সব ধরনের সহযোগিতা। তাদের বিরুদ্ধেই বুক চিতিয়ে লড়ে যাচ্ছেন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা। প্রাণে প্রাণে প্রেরণা দিচ্ছে ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’ জাতীয় গানগুলো। ঠিক সেই সময় ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট হাজার মাইল দূরের মার্কিন দেশেরই নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে রচিত হলো এক অনন্য ইতিহাস- ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। যেখানে বাংলাদেশের পক্ষে সুরের ঝংকার তুললেন মানবতাবাদী একদল শিল্পী, যা মুহূর্তেই নাড়িয়ে দেয় গোটা বিশ্বকে। বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থাকা ঐতিহাসিক সেই সংগীতানুষ্ঠানের ৫০ বছর পূর্তি আজ।
কিন্তু কী ছিল সেই আয়োজনের প্রেক্ষাপট! বাংলার মানুষের ওপর পাকিস্তানিদের নৃশংসতা আর মানবতার বিপর্যয় দেখে অন্য অনেকের মতো প্রাণ ডুকরে কেঁদে উঠেছিল ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তি সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্করের, যাঁর পূর্বপুরুষের ভিটা নড়াইলের কালিয়ায়। তিনি ডাকলেন প্রিয় শিষ্য বিটলস ব্যান্ডের অন্যতম গায়ক জর্জ হ্যারিসনকে।
বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত সেতার বাদক পণ্ডিত রবি শঙ্করকে। তার চিন্তার ফসল 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' সেই ৭১’এর কঠিন পরিস্থিতিতে তহবিল জোগাড়ের পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। মূলত মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের দুর্ভোগ লাঘবের চেষ্টার পাশাপাশি বাংলাদেশকে নৈতিক সমর্থন জানানো অর্থাৎ বাংলাদেশের জনগণকে সহায়তার জন্য উদ্যোগটি নিয়েছিলেন রবি শঙ্কর।
তিনিই প্রথম কথা বলেন পপ সঙ্গীতের সুপরিচিত ব্যান্ড বিটলসের অন্যতম সদস্য জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে, এবং তিনি সম্মত হওয়ার পরে নিজেই যোগাযোগ করেন আরও শিল্পীদের সাথে। এরপর রচিত হয়েছে একটি ইতিহাস - ৪০ হাজারের বেশি মানুষ নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে এমন একটি আয়োজনে যোগ দিয়েছিলেন, যে ধরণের আয়োজন এর আগে বিশ্বের মানুষ কখনও দেখেনি।
১৯৬৫ সালে রবিশঙ্করের কাছে সেতারের তালিম নিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন। কিন্তু তিন-চার বছর পরই বুঝে গিয়েছিলেন, তাঁর পক্ষে ভালো সেতারবাদক হওয়া সম্ভব নয়। তাই সেতার ছাড়লেন। কিন্তু ‘গুরুদক্ষিণা’ বাকি থেকে গিয়েছিল। একাত্তরে জর্জ হ্যারিসনের কাছে যেন সেই গুরুদক্ষিণা চাইলেন রবিশঙ্কর।
তিনি বললেন, বাংলাদেশে যুদ্ধে আক্রান্ত অসহায়দের জন্য কিছু করতেই হবে। দুজনে ঠিক করলেন, বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়তে এবং অসহায় মানুষের সহায়তায় তহবিল সংগ্রহের জন্য আয়োজন করা হবে একটি কনসার্ট। এর পর থেকেই জর্জ হ্যারিসন যোগাযোগ করেন খ্যাতিমান শিল্পী বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রিস্টন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেলসহ অন্যদের সঙ্গে, যাঁরা সেই কনসার্টে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন। কনসার্টে রবিশঙ্করের সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের আরো তিন কিংবদন্তি শিল্পী অংশ নেন। তাঁরা হলেন ওস্তাদ আলী আকবর খান, ওস্তাদ আল্লা রাখা ও কমলা চক্রবর্তী।
বিষয়টি নিয়ে পরে এক সাক্ষাত্কারে জর্জ হ্যারিসন বলেছিলেন, প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল রবিশঙ্করের পরিকল্পনা। তিনি বাংলাদেশের জন্য কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন। আমার সঙ্গে কথা বলে তিনি তাঁর উদ্বেগের কথা জানান। জানতে চান, আমার কোনো পরামর্শ আছে কি না। এরপর আমরা শো করার বিষয়টি নিয়ে মাঝরাত পর্যন্ত কথা বলি। তার পরই সিদ্ধান্ত নিই, আমি অনুষ্ঠানটি করব। তখন অনেককে একত্র করার চেষ্টা করি। আমাকে কিছু জিনিস সংগঠিত করতে হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন। আসলে এটাই। পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সফলভাবে এর বাস্তবায়ন পর্যন্ত পুরো আয়োজনটি সম্পন্ন করতে সময় লেগেছিল মাত্র চার সপ্তাহ।
কনসার্টের দিনটি ছিল রবিবার। সেদিন প্রথমে একটি শো হওয়ার কথা থাকলেও দর্শক-শ্রোতা বেশি হওয়ায় দুটি শো করতে হয়। টিকিট কেটে দুই শোতেই ৪০ হাজারের মতো মানুষ অংশ নেয়। প্রথম শো শুরু হয় দুপুর আড়াইটায়, দ্বিতীয় শো রাত ৮টায়।
শুরুতেই দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশে রবিশঙ্কর বলেন, আমরা কোনো রাজনীতি করতে আসিনি, আমরা শিল্পী। আমরা এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুধু একটি বার্তাই পৌঁছে দিতে সমবেত হয়েছি। আমরা চাই আমাদের সংগীত আপনাদের বাংলাদেশের মানুষের তীব্র বেদনা আর মনোযন্ত্রণা অনুভব করতে সহায়তা করুক।
কনসার্ট শুরু হয় সেতারবাদক রবিশঙ্কর, সরোদবাদক আলী আকবর খান, তবলাবাদক আল্লা রাখা ও তানপুরাবাদক কমলা চক্রবর্তীর পরিবেশনা দিয়ে। তাঁরা বাংলাদেশের পল্লীগীতির সুরে ‘বাংলা ধুন’ নামে একটি পরিবেশনা করেন। এরপর একে একে অন্য ব্যান্ডদলের বিখ্যাত শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করেন।
সেদিন অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন প্রতিবাদী গানের রাজা বব ডিলান। তিনি গেয়েছিলেন ছয়টি গান। ডিলানের সঙ্গে গিটার বাজিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন, ব্যাস লিওন রাসেল ও ট্যাম্বুরিন রিঙ্গো স্টার।
অনুষ্ঠানে বিটলসের অন্যতম সদস্য রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, ডন প্রেস্টন প্রমুখ গান গেয়েছেন, গিটার বাজিয়েছেন।
সেই অনুষ্ঠানে আটটি গান গেয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন। সবার শেষে নিজের লেখা ও সুরে গাইলেন তাঁর কালজয়ী ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ গানটি, যেখানে তিনি বলেছেন, ‘বন্ধু আমার এলো একদিন/ চোখ ভরা তার শুধু হাহাকার/ বলল কেবল সহায়তা চাই/ বাঁচাতে হবে যে দেশটাকে তার/ বেদনা যদি বা না-ও থাকে তবু/ জানি আমি, কিছু করতেই হবে/ সকলের কাছে মিনতি জানাই/ আজ আমি তাই/ কয়েকটি প্রাণ এসো না বাঁচাই/ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ.../দেখেছি সেখানে সকলই ধ্বস্ত/কত শত প্রাণ মরে অনিঃশেষ/ দেখিনি এমন বেদনা অশেষ/ তোমরা সবাই দুহাত বাড়াও/আর বুঝে নাও/ মানুষগুলোকে সহায়তা দাও/ বাংলাদেশ বাংলাদেশ.../ দেখিনি কখনো এত দুর্যোগ/ দেখছি সেখানে সকলই ধ্বস্ত/ দেখিনি কখনো এত দুর্ভোগ/ দোহাই তোমরা ফিরিও না মুখ/ বলো এই কথা/ মানুষগুলোকে দেব সহায়তা/ বাংলাদেশ বাংলাদেশ.../ মনে হবে সে তো কোন সীমানায়/ আমরা কোথায়/ কী করে বা একে ছুড়ে দিই ফেলে/ এত যে বেদনা রাখি দূরে ঠেলে/ দেবে না তোমরা ক্ষুধিতকে রুটি সামান্য দুটি/ মানুষগুলোকে সহায়তা দাও।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত নির্মাতা ও ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রাহক লিয়ার লেভিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা, যেখানে বিশ্ববিখ্যাত, জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীদের অনেকে সমবেত হয়েছিলেন। এর পেছনে ছিল অসাধারণ একটি উদ্দেশ্য। এ দেশের মানুষও তখন বিষয়টিকে গভীরভাবে অনুভব করেছিল।
কনসার্টের প্রত্যক্ষদর্শী কাজী সাহিদ আহমেদ বলেন, ‘এই দেশে (যুক্তরাষ্ট্রে) যেটাকে আমরা গেমচেঞ্জার বলি, এটা (কনসার্ট ফর বাংলাদেশ) কিন্তু গেমচেঞ্জার ছিল। কারণ লোকজন তখন এই কনসার্ট থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে শুরু করল।’
দুটি বেনিফিট কনসার্ট ও অন্যান্য অনুষঙ্গ থেকে পাওয়া অর্থ প্রায় আড়াই লাখ ডলার ইউনিসেফের মাধ্যমে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। প্রকাশিত হয় কনসার্টের লাইভ অ্যালবাম, যা রীতিমতো বিক্রির রেকর্ড গড়ে। একটি বক্স থ্রি রেকর্ড সেট এবং অ্যাপল ফিল্মসের তথ্যচিত্র ১৯৭২ সালে চলচ্চিত্র আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৭৩ সালে যা বেস্ট অ্যালবাম হিসেবে জিতে নেয় গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৭১ সালে ছিলেন ওয়াশিংটন দূতাবাসের ইকোনমিক কাউন্সিলর। যুদ্ধ শুরুর পর তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের জন্য কাজ শুরু করেছিলেন।
তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট নিক্সন, হেনরি কিসিঞ্জার এবং কিছু কর্মকর্তা বাদে আমেরিকার কেউই সেই অর্থে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল না, বরং তখন ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল হিলে আমার বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল। আমাদের পক্ষে সমর্থন ছিল ব্যাপক। সেই সঙ্গে ওই যে ঐতিহাসিক কনসার্টটি হয়েছিল, সেটিও মূলত ছিল নিক্সন ও কিসিঞ্জারের নীতির বিরুদ্ধে।
স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ওস্তাদ আলী আকবর খানের বড় ছেলে ওস্তাদ আশীষ খান বলেন, বাবা বাংলাদেশের কথা বলতেন। খুব ভালোবাসতেন। দেশের জন্য কিছু করার বড় একটি সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। এতে তিনি খুব আনন্দিত হয়েছিলেন। বিশেষ করে একটি দেশের জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর নামটিও। এটি খুবই গর্বের ব্যাপার।
২০০১ সালে জর্জ হ্যারিসন এবং ২০১২ সালে পণ্ডিত রবিশঙ্কর পাড়ি জমিয়েছেন অনন্তলোকে। তবে মুক্তিযুদ্ধের এই মহান বন্ধুরা অমর হয়ে থাকবেন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে।
প্রজন্মনিউজ২৪/ফাহাদ
সেভ দ্য রোডের ১৫ দিনব্যাপী সচেতনতা ক্যাম্পেইন সমাপ্ত
আইপিএল জুয়াড়ি সন্দেহে চারজন গ্রেফতার
রাজধানীর বনশ্রীতে আবাসিক ভবনে আগুন
খালেদা জিয়া ডাল-ভাত খাওয়াতেও ব্যর্থ হয়েছিল : শেখ হাসিনা
সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনী আর নেই
গাজা: বিমান হামলায় বেঁচে যাওয়া বালকের প্রাণ গেল সাহায্য নিতে গিয়ে
ঢাকায় আসতে না পেরে দুবাই-শারজাহর ১০ ফ্লাইট বাতিল
রাজবাড়ীতে ঘুড়ি উৎসব ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা অনুষ্ঠিত