সৌদি-আমিরাত দ্বন্দ্ব: মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দামে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে

প্রকাশিত: ০৯ জুলাই, ২০২১ ১১:৪৬:৪৭

সৌদি-আমিরাত দ্বন্দ্ব: মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দামে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে

তেল উৎপাদনের কোটা নিয়ে সৌদি আরব আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে এ সপ্তাহে প্রকাশ্য তিক্ত মতভেদের পর বিশ্বের বড় তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো তাদের মধ্যে আলোচনা স্থগিত করে দিয়েছে। এর ফলে জ্বালানি তেলের বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। তেলের দাম ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

ওপেক প্লাস গোষ্ঠীতে যে ২৩টি দেশ অন্তর্ভুক্ত, তার মধ্যে রয়েছে মূল ওপেকের সদস্য দেশগুলো ও ওপেকের সদস্য নয় এমন তেল উৎপাদনকারী সহযোগী দেশ। যাদের মধ্যে রয়েছে রাশিয়া, ওমান, বাহরাইনসহ ১০টি দেশ। ওপেক প্লাসকে তাদের আলোচনা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দিতে হয়েছে। এতে ওই গোষ্ঠী টিকবে কি না তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় গত ১৮ মাস এই গোষ্ঠী তেলের সরবরাহ অক্ষুণ্ণ রাখার কাজ করেছে। ওপেক প্লাসের নেতা সৌদি আরব ও রাশিয়া উৎপাদনের মাত্রা কম রাখার মেয়াদ আরো আট মাস বাড়ানোর প্রস্তাব দিলে সংযুক্ত আরব আমিরাত তা প্রত্যাখান করে। এরপর গত সপ্তাহে তৈরি হয় সমস্যা।

সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) চায় উৎপাদনের যে মাত্রাকে মূল ভিত্তি হিসেবে এখন ধরা হচ্ছে, সেটা পুনর্নিধারণ করা হোক। অর্থাৎ উৎপাদন কতটা কমানো বা বাড়ানো হবে তা হিসাব করার জন্য যে মাত্রাকে ভিত্তি হিসেবে ধরা যাচ্ছে, তা আলোচনার মাধ্যমে বাড়ানো হোক, যাতে তেলের উত্তোলন আরো বাড়ানোর ব্যাপারে তাদের স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু সৌদি আরব আর রাশিয়া এর বিপক্ষে ছিল। কিন্তু ঘনিষ্ঠ দুই মিত্র দেশ, ইউএই আর সৌদি আরবের জ্বালানি মন্ত্রীরা যখন প্রকাশ্যে এ নিয়ে তাদের মতভেদ ব্যক্ত করেন তখন এই গোষ্ঠীর আলোচনা একটা অস্বাভাবিক দিকে মোড় নেয়। তাদের এই মতভেদ সবাইকে চমকে দিয়েছে। যদিও হয়তো এই বিভেদটা অবশ্যসম্ভাবী ছিল বলে মন্তব্য করেছেন ওয়াশিংটনে সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশানাল স্টাডিসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বেন কাহিল।

তিনি বলছেন, ওপেক যে কোটা বেঁধে দিয়েছে তা আবু ধাবির উৎপাদন সক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আবু ধাবি তার তেল উৎপাদন শিল্পে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। এখন চাহিদাও আবার বাড়তে শুরু করেছে। ফলে ইউএই তাদের উৎপাদন বাড়াতে না পেরে গত বছর হতাশ হয়েছে। বহু বছর ধরে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে অংশীদারিত্ব আরব দুনিয়ার ভূ-রাজনীতির রূপরেখা নির্ধারণ করে এসেছে। এই জোটের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও আবু ধাবির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদের মধ্যকার ব্যক্তিগত বন্ধন।

এই দুই যুবরাজই কার্যত তাদের দেশ শাসন করেন ও তাদের লক্ষ্যও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। বেশ অনেকগুলো বছর ধরে দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত বিষয়ে গভীর সহযোগিতা ছিল। তারা ইয়েমেনে ইরানের সাথে সংশ্লিষ্ট বিদ্রোহী হুজি আন্দোলন দমন করার জন্য হুজিদের সাথে লড়তে ২০১৫ সালে একটি আরব সামরিক জোট গঠন করেছিল। ২০১৭ সালে তারা কাতারের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। কিন্তু দু’বছর আগে ইউএই ইয়েমেন থেকে তাদের গরিষ্ঠসংখ্যক সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়ার পর এই দুই যুবরাজের মধ্যে সম্পর্কে ফাটল ধরে। আমিরাতের ওই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয় সৌদি আরব।

গত জানুয়ারি মাসে কাতারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার জন্য সৌদি নেতৃত্বে যে চুক্তি হয়, আমিরাত তা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিয়েছিল। যদিও কাতার কর্তৃপক্ষের প্রতি তাদের অনাস্থা চলে যায়নি। একইভাবে গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাত যখন ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সৌদি আরবও তাতে সন্তুষ্ট হয়নি। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এই ফাটল আরো গভীর হতে শুরু করে। সৌদি আরব বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে একটা আলটিমেটাম দেয় এই বলে যে তারা যদি উপসাগরীয় এলাকায় তাদের আঞ্চলিক সদর দফতর গুলো ২০২৪ সালের ভেতর সৌদি আরবে স্থানান্তর না করে। তাহলে সরকারি কোনো চুক্তি তাদের সাথে করা হবে না। ওই এলাকায় ব্যবসা বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র দুবাই এই হুমকি ভালো চোখে দেখেনি। তারা এটিকে ইউএইর ওপর পরোক্ষ একটা হামলা বলেই বিবেচনা করেছে।

ওপেক প্লাসের প্রস্তাবে আমিরাত বাধা দেবার পর সৌদি আরব কার্যত এর প্রতিশোধ নিতে ইউএই-তে বিমান চলাচল সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। যদিও সৌদিরা বলছে এর পেছনে কারণ করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে উদ্বেগ। কিন্তু আসন্ন ঈদুল আজহার ছুটিতে বহু মানুষ যখন দুবাইয়ের দিকে ছোটে তখন এই বিমান চলাচল স্থগিত করার সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ শুধু করোনাভাইরাস কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সৌদি আরব আরো ঘোষণা করেছে যে তারা মুক্ত বাণিজ্য এলাকা থেকে বা অন্য যেসব উপসাগরীয় দেশের সাথে ইসরাইলের বাণিজ্যিক শুল্ক সুবিধার চুক্তি আছে সেসব দেশে থেকে পণ্য আমদানি করবে না। এটিও আমিরাতের জন্য বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে একটা বড় ধাক্কা, কারণ ইউএই-র বাণিজ্য ব্যবস্থা মুক্ত বাণিজ্য কাঠামোর আওতাধীন।

অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা- ওপেক প্লাসের মধ্যে এই টানাপোড়েনের পেছনে রয়েছে এই দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। দুই দেশই জ্বালানি রপ্তানির ওপর তাদের নির্ভরতা কমিয়ে তাদের অর্থনীতিকে অন্য খাত নির্ভর করে তুলতে চাইছে। মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে সৌদি আরব তাদের অর্থনৈতিক কাঠামোয় আমূল পরিবর্তনশীল কৌশল নিচ্ছে। তারা এখন পর্যটন, আর্থিক সেবা ও প্রযুক্তি খাতে প্রতিযোগিতার জন্য বাজার গড়ে তুলছে।

মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব একটা বৃহৎ দেশ। তারা এখন জেগে উঠছে। এটা বিভিন্ন কারণে আমিরাতের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন লন্ডনে চ্যাটাম হাউসের বিশ্লেষক নিয়েল কুইলিয়াম। তিনি বলেন, সৌদি আরব যদি আগামী ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে গতিশীল একটা অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়, তাহলে সেটা আমিরাতের অর্থনীতির মডেলের জন্য একটা হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সৌদি আরব ও ইউএই নতুন ওপেক প্লাস চুক্তিতে শেষ পর্যন্ত একমত হতে পারবে কি না তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু সৌদি বিশ্লেষক আলী শিহাবি মনে করেন না যে দুই দেশের এই মতবিরোধ দীর্ঘমেয়াদে তাদের সম্পর্কের ক্ষতি করবে। যদিও অবশ্য ওপেক প্লাসের প্রস্তাব নিয়ে আমিরাত যে কঠোর অবস্থান নিয়েছে তা সৌদিদের বিস্মিত করেছে। বিশেষ করে যখন দুটি দেশ একটা মতৈক্য অর্জনের লক্ষ্যে খুবই পরিশ্রম করেছে।  প্রত্যেক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই উত্থান পতন আছে। এমনকি আমেরিকা ব্রিটেনের মধ্যেও সম্পর্কে টানাপোড়েন হয়েছে। কিন্তু এই দুটি দেশের সম্পর্কের মূল ভিত্তিটা আসলেই অনেক জোরালো। ফলে এই জোটের স্থায়ী ক্ষতি হবে না।#সূত্র:বিবিসি।

প্রজন্মনিউজ২৪/ফাহাদ
 

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ