৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকা,

পশ্চিমবঙ্গে বামদের জনপ্রিয়তা তলানিতে কেন?

প্রকাশিত: ০৪ মে, ২০২১ ০৪:৫২:৪৮

পশ্চিমবঙ্গে বামদের জনপ্রিয়তা তলানিতে কেন?

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে একটিও আসন পায়নি বামপন্থিরা। আর ভারতের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল কংগ্রেস প্রার্থীরাও শূন্য হাতে ফিরেছে৷

স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গে এহেন ‘অঘটন’ এই প্রথম৷ এ নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জার্মান ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিজেপির তাবড় নেতা, অর্থবল, লোকবলের বিরুদ্ধে কেমন ‘একাই একশ’ হয়ে লড়ে গেলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সে নিয়ে কথা হচ্ছে অবশ্যই৷ কিন্তু তার থেকেও বেশি কথা হচ্ছে, এতদিন সঙ্ঘ পরিবারের প্রভাবমুক্ত এই রাজ্যে বিজেপির প্রধান বিরোধী দল হয়ে যাওয়া৷ কিন্তু তাকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে আলোচনা, যে এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বামফ্রন্ট বা কংগ্রেসের একজন বিধায়কও থাকবেন না, যারা এর আগে এই রাজ্যে ক্ষমতায় থেকেছে৷

কংগ্রেসের দিক থেকে এবারের বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে একটা গা–ছাড়া ভাব শুরু থেকেই ছিল৷ আব্বাস সিদ্দিকির ইন্ডিয়ান সেকুলার ফন্ট–এর সঙ্গে জোট বেঁধে, বামেদের সঙ্গে নিয়ে সংযুক্ত মোর্চা তৈরির পরও নজরে পড়েছে কংগ্রেসের উদ্যমহীনতা৷ জাতীয় স্তরের কোনো কংগ্রেসি নেতা প্রচারে আসেননি, এমনকি রাজ্যের নেতাদেরও সেভাবে দেখা যায়নি মিটিং-মিছিল করতে৷ জানা গিয়েছিল, সিদ্দিকির আইএসএফ-এর সঙ্গে জোট নিয়ে কংগ্রেসের উচ্চতম নেতৃত্ব অস্বস্তিতে আছে৷

তুলনায় অনেক বেশি সমালোচিত হচ্ছে বামফ্রন্ট৷ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর, মাত্র ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে যাদের শক্তি শূন্যে গিয়ে ঠেকেছে৷ গত লোকসভা ভোটে বামেদের ভোট কমে ছয় শতাংশে দাঁড়িয়েছিল৷ এবার বিধানসভা ভোটে আরো কিছুটা কমে সেটা ৫.‌৫ শতাংশ৷ এর জন্য ফের সেই সিদ্দিকির দলের সঙ্গে জোট করার সিদ্ধান্তই সমালোচিত হচ্ছে৷ বলা হচ্ছে, নামে সেকুলার ফ্রন্ট হলেও অতীতে আব্বাস সিদ্দিকি যে ধরনের আপত্তিকর কথাবার্তা বলেছেন, তাকে ধর্ম নিরপেক্ষ বলা যায় না৷ তার সঙ্গে হাত মেলানোটা বাম ভোটাররা ভালোভাবে নেননি৷
 
নির্বাচনি সংখ্যাতত্ত্ববিদ বিশ্বনাথ চক্রবর্তী জোর দিয়ে বলছেন, এবার বামেদের এবং কংগ্রেসের ভোট নিশ্চিত তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে গেছে৷ তিনি বললেন, ‘‌‘‌পশ্চিমবঙ্গে এবার ভোটের আগে যে ‘‌নো বিজেপি’ প্রচার হয়েছিল, এটা তারই ফল৷ বাম, কংগ্রেস, তৃণমূল, সেই সঙ্গে বুদ্ধিজীবীরা, বাম লিবারেলরা এই নো বিজেপি প্রচার চালিয়েছিল৷ তার সুফল পেয়েছে তৃণমূল৷ বাম এবং কংগ্রেসের প্রায় সমান সমান ভোট তৃণমূলের পক্ষে পড়েছে৷’’

সোমবার সংযুক্ত মোর্চার পক্ষে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুও কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন যে, মোর্চা যে ভোট পায়নি, সে ভোট সম্ভবত তৃণমূলের পক্ষেই গেছে৷ প্রাক্তন বিধায়ক, সিপিএম নেতা তন্ময় ভট্টাচার্য বলছেন, হতেই পারে৷ কিন্তু বুথভিত্তিক পরিসংখ্যান হাতে না এলে নির্দিষ্টভাবে তেমন কথা বলা যায় না৷ বামেরা যে ভোট পেয়ে আসছে, তার থেকে কত ভোট কমেছে এবং তৃণমূলের কোথায় কত ভোট বেড়েছে, সেটা মিলিয়ে দেখেই এরকম একটা সিদ্ধান্তে আসা যায়৷
 
কিন্তু বামপন্থিরা এবারের ভোটে নিজেদের হারানো জমি ফিরে পেতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছে৷ বেশ কয়েকজন নবীন বাম প্রার্থী এবার ভোটে দাঁড়িয়েছেন৷ তারা সারা রাজ্য ঘুরে প্রচার করেছেন৷ সোশাল মিডিয়াতেও তাদের পক্ষে জনসমর্থন দেখা গিয়েছে৷ তা হলে বামেরা শূন্যে গিয়ে পৌঁছল কেন?‌ তন্ময় ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‌‘‌তরুণ প্রার্থী দিলেই হয় না৷ পার্টির ভাবনায় তারুণ্য থাকতে হয়৷ আমি ১০টা তরুণ প্রার্থী দিলাম, কিন্তু আমরা তারুণ্যকে প্রাধান্য দিলাম না, আমার ভাবনাটা বৃদ্ধ থাকলো, তাহলে সেই তরুণরা যে ভাবনাগুলো মানুষের কাছে নিয়ে যাবে, তার মধ্যে আমার ভাবনাই প্রতিফলিত হবে!‌’’

তন্ময় ভট্টাচার্যের এই সোজাসাপ্টা কথা পশ্চিমবঙ্গের বাম রাজনীতিতে রীতিমতো আলোড়ন তুলেছে ভোটের পর৷ যেখানে তিনি সাফ বলছেন দলের উচ্চতর নেতৃত্বে বদলের কথা, যেখানে আদ্যিকালের রাজনৈতিক ধারণা নয়, আধুনিক ভাবনা গুরুত্ব পাবে৷ বিতর্ক শুরু হয়েছে৷ হতে পারে, এই বিরোধ থেকেই ভবিষ্যতে নতুন পথে হাঁটতে উৎসাহিত হবেন বাঙালি বামপন্থিরা৷

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বামপন্থি ও কংগ্রেসদের একটি আসনও না পাওয়ার পেছনে আরও দুটি উল্লেখযোগ্য কারণ বিদ্যমান। এর মধ্যে একটি হলো সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ভোট, আরেকটি হলো বিজেপি বিরোধী ভোট।

মোদি সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এনআরসি ও সিএএ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আতংকিত ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমরা। বিজেপি সরাসরি ঘোষণা দিয়েছিল যে, তারা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসলে এনআরসি ও সিএএ বাস্তবায়ন করবে। মুসলিমদের হেয় প্রতিপন্ন করে একাধিক বক্তব্য দেয়ায় মুসলিমরা বিজেপি ঠেকাও হিসেবে তৃণমূলকে একাট্টা সমর্থন দিয়েছে। অথচ এর আগে মুসলিমদের ভোটগুলো কংগ্রেস ও বামপন্থিদের ভোটবাক্সে পড়তো।

এছাড়া মমতার কিছু উদ্যোগ মুসলিম সম্প্রদায়কে ব্যাপকভাবে তৃণমূলকে ভোট দিতে উৎসাহিত করেছে। যেমন- সরকার থেকে ইমামদের ভাতা প্রদান (যা অনেক মুসলিম দেশেও হয় না) , রোজায় ইফতারিতে অংশগ্রহণ, বক্তব্যে ইনশাআল্লাহ বলা। বিশেষ করে এনআরসি ও সিএএ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরাসরি বিরোধিতা করে তার রাজ্যে এটি বাস্তবায়ন না করার অঙ্গীকার মুসলিম সম্প্রদায়কে আশাবাদী করেছে।

বিপরীতে কংগ্রেস ও বামপন্থিরা এনআরসি ও সিএএ নিয়ে তেমন স্পষ্ট কিছু বলেনি। এ নিয়ে মোদির বিরুদ্ধে সরব হতে দেখা যায়নি। আর বাবরী মসজিদ ইস্যুতে কংগ্রেস বরং বিজেপির কর্মকাণ্ডকে প্রকাশ্যে স্বাগত জানিয়েছে। এসব কারণে ওই দলের প্রাথীরা মুসলিমদের আস্থায় যেতে পারেনি।

আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘন ঘন সফর বিজেপিবিরোধীদের ব্যাপকভাবে আতংকিত করেছে। রাজ্যে বিজেপি জিতলে কী হতে পারে তার শংকায় কংগ্রেস ও বামপন্থি সমর্থকরাও ভোট নষ্ট করতে যায়নি। 

নন্দীগ্রামে আলোচিত নির্বাচনে মমতাকে ১৯৫৩ ভোটে পরাজিত দেখানো হয়েছে, অথচ বামপন্থি জোটের প্রার্থী সেখানে ৬ হাজারেরও বেশি ভোট পেয়েছেন। এমন পরিস্থিতির কথা আগেভাগে চিন্তা করে যেসব আসনে বিজেপির শক্ত প্রার্থী ছিল সেখানের সব বিজেপি বিরোধী ভোট একজোট হওয়ায় বামপন্থি ও কংগ্রেস এবার শূন্য হাতে ফিরেছে।

এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি অধীর চৌধুরী বলছেন, 'সাম্প্রদায়িক প্রচারের কাছে হেরেছি। মমতা সাম্প্রদায়িক প্রচার করলেন। মোদীকে ঠেকাতে দিদিকে ভোট দাও। কংগ্রেস যে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে মোদীর বিরুদ্ধে লড়ছে, লড়বে সেই ভরসা মুসলিমরা রাখতে পারলেন না। আমরা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে মুসলিমরা মারা গেলেন। প্রচার হলো, মোদী মুসলিমদের মারবে। এর মোকাবিলা আমরা করতে পারলাম না।'

প্রজন্মনিউজ২৪/এএআই

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ