পূর্বাচলে অবৈধ ৮৯ প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দ

রাজকীয় কেলেঙ্কারিতে রাজউক

প্রকাশিত: ২৫ জানুয়ারী, ২০২১ ১২:১৮:২০

রাজকীয় কেলেঙ্কারিতে রাজউক

লে-আউটের অনুমোদন নেই। প্ল্যানে কি আছে জানে না পরিকল্পনা বিভাগ। কোনো শাখা থেকেও প্রস্তাবনা যায়নি। রয়েছে উচ্চ আদালতের আদেশ-নিষেধাজ্ঞাও। যথাযথ বিধানের তোয়াক্কা না করেই নতুন ৮৯টি প্রাতিষ্ঠানিক প্লট ভাগ-বাটোয়ারা করেছেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)র কর্মকর্তারা। প্লটগুলোর বরাদ্দ পেয়েছেন দেশের প্রভাবশালী, শিল্পপতি-ব্যসায়ী এবং রাজনীতিকরা। ইচ্ছেমতো লে-আউট তৈরি আর বরাদ্দের এই ‘মেকানিজম’ করা হয়েছে ‘ডাটা এক্সপার্ট লি:’ নামক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে। অননুমোদন এবং আদালত অবমাননার মতো গুরুতর এ অভিযোগের স্বীকারোক্তি রয়েছে রাজউকের নথিতে। বরাদ্দপ্রাপ্তদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে এখন চেষ্টা চলছে, বেআইনি কার্যকলাপ উচ্চতর আদালত থেকে অনুমোদন করিয়ে নেয়ার।

রাজউক সূত্র জানায়, ‘পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প’র বিভিন্ন আয়তনের আবাসিক প্লট রয়েছে ২৫ হাজারের মতো। এর মধ্যে ১৫ হাজারের বেশি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বরাদ্দ প্রক্রিয়ার মধ্যে ২০০৪, ২০০৫, ২০০৯ এবং ২০১৩ সালে লে-আউট পরিবর্তন করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিটি পরিবর্তনের আগে উচ্চ আদালতের পূর্বানুমোদন নেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। এ নির্দেশনা ভঙ্গ করেই ২০১৭ সালে ৫ম বারের মতো পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের লে-আউট সংশোধন করা হয়। প্রথম লে-আউটে চিহ্নিত প্রাতিষ্ঠানিক প্লটগুলোকে কেটে-ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করা হয়। সৃষ্টি করা হয় অন্তত: ৮৯টি নতুন প্রাতিষ্ঠানিক প্লট। বিপরীতে অফিসিয়ালি জমা নেয়া হয় কোটি কোটি টাকা। তবে অভিযোগ রয়েছে, প্লটগুলোর বিপরীতে ‘আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং’ই হয় কয়েকশ’ কোটি টাকা। রাজউকের তৎকালিন চেয়ারম্যানসহ প্রভাবশালী কয়েকজন কর্মকর্তা বৃহৎ এ দুর্নীতি এবং অনিয়মের সঙ্গে জড়িত।

সূত্রমতে, দুর্নীতিপ্রবণ দফতর হিসেবে রাজউক চিহ্নিত। রাজউক ভবনের ইট-কাঠও ঘুষ খায়-এমন কথা রয়েছে। বরাদ্দকৃত প্লটের সামান্য একটি সেল পারমিশন নিতেও সাধারণ মানুষের জুতার সুকতলা কয়েক দফা ক্ষয় হয়। প্লট বরাদ্দের কাগজ পেয়েও যেখানে দখল বুঝে পায় না পূর্বাচলের নতুন শহর প্রকল্পের বহু গ্রাহক, সেখানে কোনো ধরনের কায়ক্লেশ ছাড়াই বিত্ত ও প্রভাবশালীদের মাঝে বিলি-বণ্টন করে দেয়া হয়েছে ৮৯টি প্রাতিষ্ঠানিক প্লট।

পূর্বাচল প্রকল্পের অননুমোদিত এ লে-আউট সংশোধনীতে অন্তত ১শ’ একর জায়গাজুড়ে দেখানো হয়েছে ‘আইকনিক টাওয়ার’। কেঁটে-ছিঁড়ে আবাসিক প্লটের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। পূর্বতন লে-আউট সংশোধন করে টুকরো টুকরো করা হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক প্লট। এসব প্লটে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।

পূর্বাচলের নকশার চতুর্থ সংশোধনীর পর প্রাতিষ্ঠানিক প্লট ছিল ২২৬টি। মোট আয়তন ছিল ৩৯৭ দশমিক ১৬৬ একর। পঞ্চম সংশোধনীতে কাটাছেঁড়া করে প্লটের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে প্লটের মোট আয়তন থেকে ৮৪ দশমিক ২১২ একর জায়গা কমে গেছে। আর প্লটের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১৫টি। সংখ্যা বাড়ানোর জন্য কমানো হয়েছে প্লটের আয়তন। একটি প্লট কেটে দুই থেকে তিনটি প্লট করা হয়েছে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় রাখা হয়েছিল ৩টি সেখানে ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়। হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা ২৭টি থেকে বাড়িয়ে ৪৪টি করা হয়। গবেষণা ও শিক্ষাসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান বা ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ৫টি থেকে ২১টি, মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের সংখ্যা ৬টি থেকে ২৮টি করা হয়েছে। তবে নার্সারি ও প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা কমানো হয়েছে। কমানো হয়েছে খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থান। এর ফলে একদিকে যেমন আবাসিক প্লটের আয়তন সংকুচিত হয়েছে। তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক প্লটেও ‘বাণিজ্যিক অঞ্চল’ হিসেবে বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। সামগ্রিকভাবে এটি নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত আধুনিক নগর চরিত্রকে ম্লান করবে বলে মনে করছেন- নগর পরিকল্পনাবিদরা।

সূত্রমতে, প্রতিটি লে-আউট পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে রাজউকে কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার ব্যক্তি স্বার্থ। তাদের আগ্রহেই প্লটের সংখ্যা বাড়িয়ে উচ্চমূল্যে বরাদ্দ দেয়া হয়। আবাসিক প্লট বরাদ্দ প্রাপ্তদের পক্ষ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বৃদ্ধির কোনো দাবি ছিল না। মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে অনুমোদিত চতুর্থ সংশোধনী ভেঙে তছনছ করা হয়। সব বিধিবিধান পাশ কাটিয়ে রাজউকের এস্টেট ও ভূমি শাখা-২ এর ভূমিকা ছিল অগ্রণী।

এ সময় রাজউকের চেয়ারম্যান ছিলেন আব্দুর রহমান। পরিকল্পনা (সদস্য) ছিলেন (বর্তমান চেয়ারম্যান) মো. সাঈদ নূর আলম। ৮৯ প্রাতিষ্ঠানিক প্লটের অস্বচ্ছ ও প্রশ্নবিদ্ধ বরাদ্দ এ বরাদ্দ নিয়ে এখন অস্বস্তিতে রয়েছে রাজউক। লে-আউটের পঞ্চম সংশোধনীর জন্য রাজউক হাইকোর্টে গিয়েছিল। অনুমোদন ছাড়া বরাদ্দ দেয়ায় হাইকোর্ট আবেদনটি খারিজ করে দেন। এখন কি পরিণতি হবে বরাদ্দকৃত ৮৯ প্লটের-এ প্রশ্ন তারা নিজেরাই তুলছেন। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় সভায় প্রতিবারই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না। সর্বশেষ গত ১০ জানুয়ারি রাজউকের সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার কার্যবিবরণীর ৭ অনুচ্ছেদে ‘নগর পরিকল্পনা শাখার কার্যক্রম’র পর্যালোচনা (গ) তে উল্লেখ করা হয়, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের লে-আউট নকশার হালনাগাদকৃত ৫ম সংশোধনী সম্পর্কিত আদালতের রায়ের বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সভাপতি (রাজউক চেয়ারম্যান) বলেন, পঞ্চম সংশোধনী ‘ডাটা এক্সপার্ট লি:’ নামীয় একটি বাইরের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দিয়ে করা হয়েছে। এ ব্যপারে রাজউকের সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা শাখা অবহিত নয়। পূর্বাচলের লে-আউট সংশোধনীর বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্টের রায় ছিল যে, ৪র্থ সংশোধনী পর্যন্ত অনুমোদিত এবং পরবর্তী কোনো সংশোধনীর ক্ষেত্রে মহামান্য আদালতের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। এই রায়ের কথা ৫ম সংশোধনী সম্পাদনকালে এবং এর প্রেক্ষিতে প্রাতিষ্ঠানিক প্ল্ট বরাদ্দ প্রদানের সময় কোনো শাখা কর্তৃক নথিতে উপস্থাপন করা হয়নি। অথচ এস্টেট শাখা থেকে হতে ৫ম সংশোধনী সম্পাদনের প্রেক্ষিতে ৮৯টি প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দ প্রদানের কার্যক্রম গৃহীত হয়। পরবর্তীতে ৫ম সংশোধনী অনুমোদনের জন্য মহামান্য হাইকোর্টে আবেদন করা হলে সেটি নামঞ্জুর হয়। এ বিষয়ে সরকারিভাবে মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেলকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ সভায় পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের লে-আউট নকশা নালনাগাদকৃত ৫ম সংশোধনী সম্পর্কিত মহামান্য আদালতের রায়ের বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ ও পরবর্তী সভায় প্রতিবেদন উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এদিকে লে-আউট অনুমোদনের আগেই বরাদ্দ দেয়ার ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে রাজউক চেয়ারম্যান মো. সাঈদ নূর আলম গতকাল রোববার ইনকিলাবকে বলেন, হাইকোর্টের অনুমোদনের আগেই বরাদ্দ সম্পন্ন হয়েছে। আশা করছি আদালত আমাদের আবেদন বিবেচনা করবেন। এরই মধ্যে আমরা অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে আবেদনের নথিপত্র পৌঁছে দিয়েছি।

সূত্র: ইনকিলাব

প্রজন্মিনিউজ২৪/নাজমুল

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ