নিরাপদ' পানি কতটা নিরাপদ!

প্রকাশিত: ৩১ অক্টোবর, ২০২০ ১১:২৬:২৩

নিরাপদ' পানি কতটা নিরাপদ!

প্রজন্মনিউজ ডেস্ক :  জীবনধারণের একটি অপরিহার্য উপাদান হলো পানি। আবার এই জীবন বাঁচানো পানি কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে হয়ে উঠতে পারে জীবননাশের কারণ। তাই নিরাপদ পানির বিষয়ে অবহেলা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক। কিন্তু নিরাপদ পানির নামে আমরা প্রতিদিন যা খাচ্ছি তা কি সত্যিই নিরাপদ?


বাংলাদেশে প্রতিদিন বিভিন্ন পানিবাহিত বা পানিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ ডাক্তারের কাছে ছুটে বেড়ায়। হাজার হাজার টাকার ওষুধ কিনে খেতে বাধ্য হয়। অথচ রোগের মূল কারণ যে জীবন বাঁচানো পানি এই বিষয়েও অজ্ঞ অসংখ্য মানুষ। সচেতন কিছু মানুষ অবশ্য আছেন, যারা বিশুদ্ধ পানি পান ও ব্যবহারের চেষ্টা করে থাকেন কিন্তু ব্যবসায়ীদের ঘোরপ্যাঁচে দুর্ভাগ্যবশত সেটা থেকে যায় অরণ্যে রোদন বা বৃথা চেষ্টা মাত্র। বেশির ভাগ বাঙালি তাদের দৈনন্দিন কাজের জন্য ব্যবহার করেন নদী-নালা, পুকুর বা অন্যান্য জলাশয়ের পানি। যার ফলে অনিরাপদ পানি পানে আমাদের পানিবাহিত ও পানিজনিত রোগ হয়ে থাকে।

আবার বাতাস থেকেও পানিতে প্রবেশ করতে পারে মারণঘাতী ব্যাক্টেরিয়া। ১৬৭৫ সালে বিজ্ঞানী এন্টনি ভন লিউয়েন হুক সর্বপ্রথম তার নিজের তৈরি অণুবীক্ষণ যন্ত্রে বৃষ্টির পানি পর্যবেক্ষণ করেন। সেই বৃষ্টির পানিতেও জীবাণু পাওয়া যায়। বিজ্ঞানী লিউয়েন হুকের পরীক্ষা থেকে বোঝা যায়, ব্যাক্টেরিয়া শুধুমাত্র ভূ-পৃষ্ঠে না, বাতাসেও থাকতে পারে। যার কারণে বৃষ্টির পানিও সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত নয়।


 
বাজারজাত মিনারেল ওয়াটারকে আমরা অনেকে ভরসার সাথে পান করি কিন্তু মিনারেল ওয়াটার বোতলে ফিলিংয়ের সময় যথাযথ নিরাপত্তা অবলম্বন না করলে সেখানেও প্রবেশ করতে পারে বাতাসে ভেসে থাকা জীবাণু। এই ব্যাক্টেরিয়া জীবাণুগুলো ‘Aerobic bacteria’ নামে পরিচিত। ‘Aerobic bacteria’ অক্সিজেনের সাহায্য ছাড়া বাঁচতে পারে না। এই জন্য পানি সবসময় ঢেকে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়। কারণ, অনিরাপদভাবে পানি রাখলে বিভিন্ন এরোবিক ব্যাক্টেরিয়া পানির সংস্পর্শে এসে মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। আর পানিতে অক্সিজেন থাকার কারণে বোতলবন্দী অবস্থাতেও ব্যাক্টেরিয়া টিকে থাকতে পারে অনন্তকাল পর্যন্ত। এ সব ব্যাক্টেরিয়া হতে রক্ষা পেতে মিনারেল ওয়াটার প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রতিটি ধাপ অত্যন্ত সুরক্ষতার সাথে পর্যবেক্ষণ ও সম্পাদন করা প্রয়োজন। কারণ অসতর্কতায় হতে পারে নানা রোগ। যেমন, যক্ষা, সাইন্যুসাইটিস, ধনুষ্টঙ্কারের মতো মারাত্মক রোগ ঘটাতে পারে এরোবিক ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণে। এই ব্যাক্টেরিয়াগুলো মূলত বাতাসে ভেসে বেড়ায়। তাই বাতাসের সাহায্যে পানির মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারে।

২০১৮ সালে বিএআরসিএ দেশের বিভিন্নস্থান হতে ৩৫টি বোতলজাত ড্রিংকিং ওয়াটারের ২৫০টি জারে পানির নমুনা পরীক্ষা করে সকলের সামনে নিয়ে আসে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাদের প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, এ সকল বোতলজাত ও জারের ১০০ মি.লি.পানিতে এক থেকে এক হাজার ৬০০ এমপিএন-এর বেশি ক্ষতিকর ই. কলাই ব্যাক্টেরিয়ার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে যেখানে বিএআরসিএ-এর মান অনুযায়ী শূন্য ই. কলাই থাকার কথা ছিল।

বিএআরসিএ সূত্র হতে জানা যায়, বাজারজাত পানি অবশ্যই খনিজ পানি হতে হবে। পাশাপাশি কারখানায় অবশ্যই রাসায়নিক পরীক্ষাগার ও রসায়নবিদ থাকতে হবে। ক্ষারত্বের মান নির্ণয় ব্যবস্থা, মেয়াদোত্তীর্ণ সময় প্রভৃতি নিয়মাবলী গুরত্বের সাথে মানার তাগিদ থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলো মানা হচ্ছে না। তবুও এ সকল পানি বিক্রয় হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা জারপ্রতি।

পানিবাহিত রোগ

পানিতে থাকা জীবাণুর কারণে দেহে বাসা বাঁধে পানিবাহিত রোগব্যাধি
যেসকল রোগের জীবাণু পানির মাধ্যমে সংক্রামিত হয়, তাদেরকে সাধারণত পানিবাহিত রোগ হিসেবে শনাক্ত করা হয়। ওই ধরনের অগণিত রোগব্যাধি থাকলেও কিছু কিছু পরিচিত ব্যাধিতে মানুষকে আক্রান্ত হতে দেখা যায় হরহামেশা। যেমন :

• ডায়রিয়া
• গিয়ার্ডিয়াসিস
• আমাশয়
• জন্ডিস
• কলেরা
• টাইফয়েড

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে মহামারি রূপ নেয়া কলেরা বা ‘ওলাওঠা’য় মারা যায় প্রায় ২২ থেকে ২৩ লাখ মানুষ। পরে বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে গবেষণার মাধ্যমে জানা যায় পানির মাধ্যমে সংক্রামিত অতিক্ষুদ্র কলেরা ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে কলেরা। এ ছাড়াও ব্যাকটেরিয়া সংক্রামিত টাইফয়েড রোগ অথবা ভাইরাসবাহিত জন্ডিস, এ সকল রোগ আমাদের খুব পরিচিত।

পানিবাহিত সবথেকে কমন রোগটি হলো ডায়রিয়া। এই রোগে ঘন ঘন পাতলা পায়খানা, পায়খানার সাথে মিউকাস, ক্ষেত্রবিশেষে রক্তও যেতে পারে। ডায়রিয়া সাধারণত ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসসহ যেকোনো প্যারাসাইট বা পরজীবীর আক্রমণে ঘটতে পারে। যেমন, ব্যাক্টেরিয়ার মধ্যে সালমনেলা,স্ট্যাফাইলোকক্কাস, শিগেলা, ক্যাম্পাইলোব্যাকটর অথবা ইশ্চেরিচিয়া কলাইয়ের (E. coli) আক্রমণে ডায়রিয়া রোগ হয়। আবার রোটাভাইরাস, ক্যালিভাইরাস, এডিনোভাইরাস, অ্যাস্ট্রোভাইরাসের কারণেও মানুষ আক্রান্ত হতে পারে ডায়রিয়া রোগে।পরজীবী প্রাণীর মধ্যে Giardiasis আক্রমণেও শরীরে বিস্তার লাভ করতে পারে ডায়রিয়া।

ডায়রিয়ার সাথে আরো একটি যে রোগের নাম মাথায় আসে। সেটি হচ্ছে আমাশয়। আমাশয় এমন একটি অবস্থা যখন মলাশয়ের মধ্যে ব্যথা বা জ্বালা হয়, পায়খানার সাথে শ্লেষ্মা বা কখনো রক্তও যেতে পারে। আমাশয় ব্যাক্টেরিয়া বা অ্যামেবিক, দুই ধরনেরই হতে পারে। শিগেলা বা ই. কলাই ব্যাক্টেরিয়া অথবা এন্টেমিবা হিস্টোলিকা প্রোটোজোয়ারই মুখ্য ভূমিকায় রয়েছে আমাশয় দুর্ভোগের পেছনে।

আরেকটি পানিবাহিত রোগ জন্ডিসের। রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়াকে জন্ডিস বলে। শরীরে বিলিরুবিনের স্বাভাবিক মাত্রা এক দশমিক দুই মি.লি./ডে.লি.। রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে ত্বক, চোখের সাদা অংশ বা অন্যান্য মিউকাস ঝিল্লী হলুদ হয়ে যায়। এছাড়াও ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি জন্ডিসের অন্যতম লক্ষণ। জন্ডিস মূলত কোনো রোগ নয়। এটি মারাত্মক অন্য কোনো রোগের উপসর্গ হিসেবে বিবেচিত হয়।

দূষিত পানির কারণে মানবদেহে বিস্তারপ্রাপ্ত পাঁচ প্রকার জন্ডিস (হেপাটাইটাইটিস এ, বি, সি, ডি, ই) ভাইরাসে সংক্রামিত হয়। সাধারণ জন্ডিস হেপাটাইটিস ’এ’ ও হেপাটাইটিস ’ই’ ভাইরাস সংক্রামিত থেকে হয়। হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের আক্রমণে লিভার সিরোসিসের মতো জটিল রোগও দেখা দিতে পারে, যার ফলাফল নিশ্চিত মৃত্যু।

তবে আশার বাণী হচ্ছে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথেই হেপাটাইটিস-বি ভ্যাক্সিন ইতোমধ্যে বিজ্ঞানীরা পৌঁছে দিয়েছেন আমাদের হাতে।

আরেকটি রোগ কলেরা Vibrio choleriae নামক ব্যাক্টেরিয়াবাহিত। সাধারণত যে সকল অঞ্চলে পরিষ্কার পানি সরবরাহের ব্যাবস্থা নেই, সেসব অঞ্চলেই কলেরা দ্বারা মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়। ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, বিশ্বে এখনো প্রতিবছর এক দশমিক তিন থেকে চার মিলিয়ন মানুষ প্রাণ হারায় কলেরা রোগে। দূষিত পানি পান করার ১২ থেকে ১৫ ঘন্টার মধ্যে কলেরার উপসর্গ দেখা যায়। যেমন, পাতলা পায়খানা, বমি, পানিশূন্যতা, পেশীতে ব্যথা ইত্যাদি। সকল বয়সের মানুষ আক্রান্ত হতে পারে কলেরা রোগে।

পানিবাহিত আরো একটি মারাত্মক রোগ হলো Salmonella typhi -এ সংক্রামিত টাইফয়েড। দূষিত পানি পানের ছয় থেকে ৩০ দিনের মাথায় শরীরে দেখা দেয় টাইফয়েডের লক্ষণ।জ্বর, পেটে ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য, মাথা ব্যথা ও গুটি গুটি ভাব টাইফয়েড রোগের অন্যতম লক্ষন।স্যালমনেলা টাইফি নামের ব্যাক্টেরিয়াঘটিত এই মারাত্মক রোগের কারণে পরিপাকতন্ত্রে রক্তক্ষরণ, অগ্ন্যাশয়ে প্রদাহ, মেরুদণ্ডে সংক্রমণ, মস্তিষ্কে প্রদাহ ও স্নায়বিক সমস্যার মতো মারাত্মক জটিলতাগুলো দেখা দিতে পারে।

পানিজনিত রোগ

পানিবাহিত রোগগুলো খুব পরিচিত হলেও পানিজনিত রোগগুলো এখনো অপরিচিত আমাদের কাছে। শুনতে অনেকটা একই রকম মনে হলেও দু’টির মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। পানিতে বিদ্যমান পদার্থগুলো ধীরে ধীরে শরীরে জমা হয়ে ডেকে নিয়ে আসে পানিজনিত দীর্ঘমেয়াদি সকল মারাত্মক রোগব্যাধিকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি জরিপে জানা যায়, ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ ক্যান্সার পানি ও পরিবেশ থেকে সৃষ্ট। ব্যাক্টেরিয়ার ভয়ে নদী-নালার পানি বর্জন করা গেলেও পানিতে অবশিষ্ট থেকে যায় নীরব ঘাতক ভারী ধাতুগুলো। বিভিন্ন গবেষণায় বারবার প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশের খাবার পানিতে ভারী ক্ষতিকর ধাতব পদার্থের অস্তিত্ব রয়েছে সহ্য মাত্রার অতিরিক্ত পরিমাণে। এসকল ভারী ধাতুর ভার সহ্য করতে গিয়ে দীর্ঘযাত্রায় কখনো বলি দিতে হয় জীবনটাকেই। ব্যাক্টেরিয়ার পাশাপাশি পানিতে থাকতে পারে তৈলাক্ত পদার্থ, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, সীসা, দস্তা,পারদ বা ক্রোমিয়ামের মতো বিষাক্ত ভারি পদার্থসমূহও। ক্রোমিয়ামের বিষাক্ততায় হতে পারে ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি। ক্যাডমিয়াম হাড়ের রোগ সৃষ্টি করে। পারদ, সীসা, অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাঙ্গানেজ, লিথিয়াম বা অন্যান্য ধাতব পদার্থ করতে পারে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি। শুধুমাত্র ভারী পদার্থ নয়, দ্রবনীয় কম ভারের পদার্থও মাত্রাতিরিক্ত গ্রহণে হতে পারে মারাত্মক রোগ। রক্তের এক বিশেষ ধরনের ক্যান্সার হয় বেশি মাত্রায় আয়রন গ্রহণের কারণে আবার ক্যালসিয়াম কিডনিতে জমা হয়ে তৈরি করতে পারে পাথর, সোডিয়াম রক্তচাপ বাড়ায় আর ক্লোরিন ধ্বংস করতে পারে শরীরের উপকারী কোষগুলোকে।

ভূ-গর্ভস্থ পানিতেও দূষণ

একুশ শতকে এসেও মানুষ খুব নিশ্চিন্তে টিউবওয়েল বা সাবমার্সিবল পাম্পের পানি পান করছে চোখ বন্ধ করেই। কিন্তু বর্তমানে আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর, সেই সাথে দূষণ থেকে রক্ষা পায়নি ভূ-অভ্যন্তরে সংরক্ষিত পানিও। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্য চাহিদা বাড়ছে এবং এই বিদ্যমান বিরাট অংশের চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর জমিতে ক্ষতিকর কীটনাশক ও সার প্রয়োগ করা হচ্ছে বেশি ফসল উৎপাদনের নিমিত্তে।মাটিতে প্রয়োগকৃত এই সার ও কীটনাশকের ক্ষতিকর কেমিকেল ভূ-গর্ভস্থ পানির সাথে মিশে দূষিত করছে পানিকে এবং সেই পানি পানে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। দাঁত ক্ষয়ে যাওয়া, দাঁতে পোকা লাগা বা অল্প বয়সেই দাঁত পড়ে যাওয়া, যা-ই বলা হোক না কেনো চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয়, ফ্লুরোসিস। ভূ-গর্ভস্থ পানিতে উচ্চমাত্রায় ফ্লোরিনের উপস্থিতিতে হতে পারে এ ধরনের গুরুতর দাঁতের সমস্যা। ফ্লুরোসিস ছাড়াও ডায়রিয়া, প্রজননতন্ত্রের জটিলতা বা স্নায়বিক মারাত্মক রোগের কারণ হতে পারে দূষিত ভূ-গর্ভস্থ পানি। তাছাড়া ইউরিয়া সারে ব্যাবহৃত এমোনিয়া ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী।

সাবমার্সিবল পাম্পগুলো ভূ-পৃষ্ঠের যতই গভীরে বসানো হোক না কেন ভূ-গর্ভস্থ পানির এক স্তরের পানির সাথে অন্য স্তরের পানি মিশ্রিত হওয়া অসম্ভব কিছুই নয় আবার সাবমার্সিবল পাম্পের পাইপের ভেতরে বা টিউবওয়েলের ভেতরেও থাকতে পারে ক্ষতিকর জীবাণুর বসবাস।পানি তোলার সময় সহজেই ওই সকল জীবাণু পানির সাথে মিশে প্রবেশ করছে মানবদেহে এবং ঘটাচ্ছে বিভিন্ন পানিবাহিত ও পানিজনিত রোগ।

ফোটানো পানিও নিরাপদ নয়

ব্যাক্টেরিয়া-ভাইরাস ধ্বংসের অনেক উপায়ের মধ্যে একটি হচ্ছে উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োগ।যদিওবা অনেক ব্যাক্টেরিয়া রয়েছে যারা উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করে স্পোর গঠন করে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে।স্পোরের কথা বাদ দিলেও ফোটানো পানিতেও অবশিষ্ট থেকে যায় দ্রবীভূত ক্ষতিকর কঠিন পদার্থ বা ভারী পদার্থগুলো।যার ফলে সৃষ্টি হতে পারে মারাত্মক রোগ এবং বিকলাঙ্গতাও।তাই পানি ফোটানো হোক বা না হোক, নিরাপদ হওয়া আবশ্যক।আর মাত্র ফোটানো পানি শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না কোনভাবেই। ক্ষতিকর কঠিন পদার্থ থেকে মুক্তি চাইলে অবশ্যই উচিত পানি থেকে ব্যাক্টেরিয়াল স্পোর এবং নির্ধারিত মাত্রার অতিরিক্ত কঠিন পদার্থগুলো দূর করা।তাই অনুসন্ধান যদি হয় নিরাপদ পানির, তবে তা ফোটানো হোক বা না হোক, পানিকে রিভার্স অসমোসিস ফিল্ট্রেশনের মাধ্যমে ফিল্টার করা উচিত।

পানি বিশুদ্ধিকরণের বিভিন্ন পদ্ধতি

আপাতদৃষ্টিতে বিশুদ্ধ পানির সন্ধান পাওয়া সোনার হরিণের মতো মনে হলেও বিষয়টি এতটাও জটিল নয়। পানি বিশুদ্ধকরণের বিভিন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় রয়েছে। শতভাগ বিশুদ্ধ পানি না পাওয়া গেলেও এ সকল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিরাপদ পানি পাওয়া সম্ভব।

ক্লোরিনেশন (Chlorination) : ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পানিকে জীবাণুমুক্ত করার পদ্ধতিকেই ক্লোরিনেশন বলা হয়।এ পদ্ধতিতে পানিতে ব্লিচিং পাউডার যোগ করলে সেটা বিয়োজিত হয়ে জায়মান ক্লোরিন [C] উৎপন্ন করে। এই জায়মান ক্লোরিন পানিতে থাকা সকল জীবাণু ধ্বংস করে। পানি জীবাণুমুক্ত করার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি ক্লোরিনেশন হলেও শুধুমাত্র ক্লোরিনেশনের মাধ্যমে বিশোধিত পানি পান উপযোগী একেবারেই নয়, এই প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত জায়মান ক্লোরিন শরীরের প্রতিরক্ষাকারী বিটা লিউকোসাইট কোষ ধ্বংস করে শরীরকে করে ফেলতে পারে রোগ প্রতিরোধে অক্ষম। সাধারণত সুইমিং পুলে এই উপায়ে স্বল্প খরচেই পানি বিশুদ্ধ করা হয়।

অতি বেগুনী ডিজইনফেকশন (UV Disinfection) : বিশ শতকে উন্নত দেশগুলোতে অতিবেগুনী রশ্মির মাধ্যমে পানিতে থাকা জীবাণু ধ্বংস করা একটি পরিচিত প্রক্রিয়া। এ পদ্ধতিতে সাধারণত Ultra Violet-C রশ্মি ব্যাবহৃত হয় অতি-আণুবীক্ষণিক জীবাণু ধ্বংস এবং ক্যান্সার সৃষ্টিকারী নাইট্রো সোডি মিথাইল এ্যামাইন যৌগের গঠন ভেঙ্গে দেয়ার জন্য। প্রচলিত ধারণা অনু্যায়ী, অতিবেগুনী রশ্মি মানুষের জন্য ক্ষতিকর হলেও ইউভি-সি দুর্বল রশ্মি হওয়ায় এটা মানবদেহের তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারে না। এই প্রক্রিয়ায় জীবাণু ধ্বংস হলেও পানিতে থাকা ক্ষতিকর ভারী কেমিক্যাল থাকলে এই পদ্ধতি উপযোগী নয় বরং এটি মদদ দিতে পারে এসকল পদার্থের ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় চেইন রিয়্যাকশনকেও। আরো একটি অসুবিধা হচ্ছে আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মির মাধ্যমে ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস বা প্রোটোজোয়ার ডিএনএ অণুর গঠন ভেঙে তাদের অকর্মন্য করা সম্ভব কিন্তু একেবারে পানি হতে দূর করার জন্য অন্য পদ্ধতির সহায়তা নিতে হয়। তাই পানি বিশুদ্ধকরণের এটিও একটি আধুনিক প্রক্রিয়া তবে সম্পূর্ণরূপে নির্ভরযোগ্য নয়।

ডিস্টিলেশন (Distillation) : ল্যাবরেটরি বা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অপরিহার্য একটি নাম ডিস্টিল্ড ওয়াটার। সাধারণত এ পদ্ধতিতে স্ফুটন তাপমাত্রার উপর ভিত্তি করে ধাপে ধাপে পানি পরিশোধন করা হয়। তাপমাত্রানির্ভর পদ্ধতি হওয়ায় এ পদ্ধতিতে জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায় এবং পানিতে থাকা ক্ষতিকর ভারী উপাদানও পৃথক করা সম্ভব। তবে গবেষণা অনুযায়ী, ডিস্টিল্ড ওয়াটার বিশুদ্ধ হলেও নিরাপদ নয়। এই পানি পানে বহুমূত্রতার সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং যেহেতু পানি হতে ভারী পদার্থের সাথে সাথে প্রয়োজনীয় অন্যান্য ধাতব পদার্থগুলোও পৃথক করা হয়, তাই এ পানি পানে শরীরের প্রয়োজনীয় ইলেকট্রোলাইটসের কমতি দেখা দেয়। যার ফলে দীর্ঘযাত্রায় হৃৎপিণ্ড বা কিডনীজনিত নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে।

বিপরীত অভিস্রাবন (Reverse Osmosis) : রিভার্স অসমোসিস বা বিপরীত পরিস্রাবন মূলত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পানি বিশুদ্ধকরণের প্রক্রিয়া। বাজারজাত বিভিন্ন ফিল্টার রয়েছে যেগুলো রিভার্স অসমোসিসের মাধ্যমে পানিকে খাবার উপযোগী করে তোলে। অসমোটিক প্রেশার প্রয়োগ করে বেশি ঘনত্বের দ্রবণকে কম ঘনত্বের রিভার্স অসমোসিস মেমব্রেনের দিকে নিয়ে যাওয়াই এই প্রক্রিয়ার মূল কাজ। এ প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত অসমোসিস মেমব্রেনের আয়তন ০.০০০১ মাইক্রন। মেমব্রেনের এই অতি আণুবীক্ষণিক অর্ধভেদ্য পর্দা পানির মধ্যে থাকা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কোনো পদার্থ বা জীবাণু ভেদ করে যেতে পারে না এবং বাধ্য হয়ে ক্ষতিকর বা দূষিত পদার্থগুলো বিপরীত পথে আবার হাঁটা দেয়। পানি বিশুদ্ধিকরণের এটি সর্বাধুনিক ও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রক্রিয়া।

সবমেষে বলা যায়, দেশের প্রতিটি মানুষের পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে আশা করা যায় প্রায় ৭০ শতাংশ অনাকাঙ্ক্ষিত রোগ-বালাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে অপার সম্ভাবনাময় এই মানবসম্পদকে।

প্রজন্মনিউজ/শেখ নিপ্পন

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন





ব্রেকিং নিউজ