বাংলাদেশে নারী পুরুষের আয়ের বৈষম্য

প্রকাশিত: ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ১০:৪৭:১৯

বাংলাদেশে নারী পুরুষের আয়ের বৈষম্য

বাংলাদেশে সরকারি বেসরকারি চাকরি তথা আনুষ্ঠানিক খাতে নারী পুরুষের বেতন বৈষম্য অনেকটা কম হলেও অনানুষ্ঠানিক খাতে বৈষম্য এখনো অনেক বেশি। গবেষক, নারী উদ্যোক্তা এবং সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে সর্বস্তরে আয় বৈষম্য নিরসন করা এখনো বাংলাদেশে একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা আইএলও'র গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্টে দেখা যায় বিশ্বে গড়ে নারী পুরুষের আয় বৈষম্য ২২ শতাংশের মতো। কিন্তু বাংলাদেশে এটি মাত্র ২.২ শতাংশ যা সর্বনিম্ন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ -বিআইডিএস এর গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ বলেন এর কারণ সবক্ষেত্রে এক নয়।
‘কোনো কোনো আয় বৈষম্য হচ্ছে কর্মদাতার সৃষ্টি আর কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বা নারীর জীবনযাত্রাটা এমন যে তার আয় বৈষম্যটা হয়েই যায়। কাজেই আমরা বাংলাদেশে যেটা দেখি অনানুষ্ঠানিক খাতে আয় বৈষম্যটা প্রবলভাবে বিদ্যমান।’

কারণটা যোগ্যতার নয়
ড. নাজনীন বলছেন, আনুষ্ঠানিক খাতে যত উচ্চ পদে নারী কাজ করেন, সেখানে আয় বৈষম্য ততই কম।‘কিন্তু আরেকটা জায়গায় বৈষম্য তৈরি হয়। আপনি বিভিন্ন জায়গায় দেখবেন যে প্রমোশনের দিক থেকে আমরা যখন উপরের দিকে যেতে থাকি, সেইখানে কিন্তু তখন নারীর সংখ্যা কমতে থাকে।’
‘এটাও কিন্তু নারী পুরুষের এক ধরনের বৈষ্যম্যেরই ইঙ্গিত বলবো এই কারণে যে সবসময় কিন্তু এটা যোগ্যতার কারণে যে হয় তা না,’ বলছেন ড. নাজনীন আহমেদ।

ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, আনুষ্ঠানিক খাতে প্রতিটা পদের বিপরীতে বেতন নির্ধারিত থাকে বলেই সেক্ষেত্রে বৈষম্যের সুযোগ কম। অনানুষ্ঠানিক খাতে বৈষম্য বেশি কারণ -কত বেতন হবে, কাকে কত টাকা মজুরি দেয়া হবে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।

‘নারী শ্রমিক যারা রাস্তার কাজ করছেন, ইট ভাঙছেন কিংবা রাস্তা-ঘাট নির্মাণের সাথে আছেন সেসব জায়গায় কিন্তু আমরা দেখি নারী শ্রমিক ৩০-৪০% পর্যন্ত মজুরি কম পেয়ে থাকে।’

ওভারটাইম পেমেন্ট
ড. আহমেদ বলছেন, আনুষ্ঠানিক খাতে অনেক সময় নারী পুরুষের বেতনের ক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা না গেলেও, আয়ের বৈষম্য অনেক সময় হয় যেখানে ওভারটাইম পেমেন্টের ব্যাপার থাকে সেখানে। তৈরি পোশাক খাতের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন যে এই খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি। কিন্তু ওভারটাইমের কারণে মোট আয়ের হিসাবে মেয়েরা পুরুষের পেছনে পড়ে যাচ্ছেন।

নারী ও পুরুষ কর্মী যারা ‘একই অপারেটর পজিশনে আছেন, তারা বেতন হয়তো একই সমান পাচ্ছেন, কিন্তু ওভারটাইমটা পুরুষই বেশি করতে পারছে’ তিনি বলেন। ‘নারী ঘরের দায়িত্ব এবং অন্যান্য কারণে কিন্তু তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছেন, ফলে ওইখানে একটা আয়

কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা
নারী পুরুষের আয় বৈষম্যের পেছনে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ এবং নিরাপত্তাও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন একজন উদ্যোক্তা তাহমীনা শৈলী।
তিনি মনে করেন, নারীরা এখনো অনেক ধরনের কাজের সুযোগ পান না। কারণ অনেক জায়গায় নারীদের অনেক ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়, এবং একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর নারীরা বাড়ি ফেরার সময় অসুবিধায় পড়েন বলে অনেক ধরণের কাজের সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হন। সেটাও আয় বৈষম্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

‘অফিসের ভেতরে সিকিউরিটি কতটা আছে সেটাও প্রশ্ন। আমি মনে করি যারা নীতি নির্ধারক বা উপরের স্তরে কাজ করছেন বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো জায়গায় কাজ করছেন, তারা যদি এ জায়গাগুলোতে ব্যক্তিগত ভাবে উদ্যোগ নেন তাহলে এর কিছুটা সমাধান সম্ভব।’

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের শ্রমশক্তির ৮৭ শতাংশেরই কর্মসংস্থান হয় অনানুষ্ঠানিক খাতে। যেখানে নারীর সংখ্যাই বেশি। শ্রম জরিপের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে নারীদের ৯২ শতাংশের কর্মসংস্থান এখনো অনানুষ্ঠানিক খাতে।

‘দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি’
বিজিএমইএ সভাপতি ড.রুবানা হক বলেন, আয় বৈষম্য নিরসন করতে হলে দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তনটা জরুরি। ‘আমার নিজের কোম্পানির জন্য বলেছিলাম একসেসোরিজ এবং ফেব্রিক সাপ্লায়ার কোম্পানিতে নারী যদি কেউ বোর্ডে না থাকেন তাহলে সেই কোম্পানির কাঁচামাল কিনবো না। তো হঠাৎ দেখা গেলো যে রাতারাতি তাদের স্ত্রী বোনকে ঢুকিয়ে দিয়েছে বোর্ডে। এখন কথা হলো যে সেরকম ফাঁকি দিলে তো দেয়াই যায়। সেটি যেন না হয়।’

রুবানা হক বলেন, শুধুমাত্র নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিলে পরিবর্তন আসবে না। এছাড়াও নানারকম ফাঁক খুঁজে সেটা জোড়াতালি দিলে উদ্দেশ্য সফল হবে না বলেই তিনি মত প্রকাশ করেন। ‘আমাদের সকলের প্রয়োজন একটা যে মাইন্ডসেট আছে - নারী কর্মসংস্থানের বিপক্ষে সেটা পরিবর্তন করা।’

‘শুধুমাত্র নারী শ্রমিকদের ব্যাপারে না, আমরা যে জায়গাগুলোতে আছি, এখানেও কিন্তু বৈষম্যের কোনো কমতি দেখি না। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের সার্বিকভাবে সকলে একসাথে এই চিত্রটা বদলাতে যুদ্ধ করতে হবে। যুদ্ধটা সকলের,’ বলছেন রুবানা হক।

বাংলাদেশে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ৩৬ শতাংশের মতো। গত কয়েক দশকে কৃষি শিল্প এবং সেবাখাতের শ্রমবাজারে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির একটা উর্ধ্বগতিও দেখা গেছে। সংগঠিত খাতে বাংলাদেশে পৌনে দুই কোটি নারী নানারকম পেশায় নিয়োজিত।

সরকারের পরিকল্পনা
তবে বেশিরভাগ নারীর কর্মসংস্থান এখনও অনানুষ্ঠানিক খাতে, এবং যেহেতু সেখানে বৈষম্য বেশি তাই এ ব্যাপারে সরকারি পরিকল্পনার দিকে অনেকেই তাকিয়ে আছেন।

পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলছেন , পূর্বের তুলনায় নারীদের অবস্থার উন্নতি হলেও সেটা আদর্শ নয় সেটা তিনি স্বীকার করছেন। ‘আমরা নীতিগতভাবে নারী পুরুষের মধ্যে সাম্যতা চাই। তবে বাস্তবক্ষেত্রে অসুবিধাগুলোকে আমরা স্বীকার করি। এবং এগুলোকে পার হবার জন্যে দৃশ্যতই আমরা তাদেরকে প্রেফারেন্স দিব।’
পরিকল্পনা মন্ত্রীর মতে, সংস্কৃতিগত কারণে নারীরা তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে আছেন।

‘সরকারি খাতে তো আমাদের কোনো মজুরির ভিন্নতা নেই। এটা অবৈধ। প্রাইভেট সেক্টরের সবকিছু যে আমাদের নলেজে হয় তা নয়। সেখানেও কিন্তু আমাদের বলা আছে নীতিগতভাবে কোনো পার্থক্য করা যাবে না। কিন্তু বাস্তবে যে সেটা হয় আমরা অস্বীকার করবো না।’

‘নারীদেরকে আমরা অগ্রাধিকার দিচ্ছি। আগামীতেও দেব তবে সবকিছু করবো একটা মসৃন পথে,’ বলেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান।

প্রজন্মনিউজ২৪/হাবিব

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন