সংঘাত বেড়েই চলেছে আওয়ামী লীগে

প্রকাশিত: ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০৫:৫৮:১৬

সংঘাত বেড়েই চলেছে আওয়ামী লীগে

অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সংঘাত ও হানাহানি বাড়ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে। গত কয়েক দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে দলটির দুই গ্রুপের সংঘাতে অর্ধশত নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। দলীয় কোন্দলের জের ধরে রবিবার কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হন। এ সময় সংঘাতে জড়ানো নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে রামদা নিয়ে আরেক পক্ষকে ধাওয়া করতে দেখা যায়। গতকাল সোমবার পাবনার ঈশ্বরদীতে দুই গ্রুপের সংঘাতে আহত হন ১২ জন, এর মধ্যে কয়েক জন ছুরিকাহত হন। এর আগে ৬ সেপ্টেম্বর পাবনার সুজানগরে জলাশয়ে মাছ চাষকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের রক্তক্ষয়ী সংঘাতে ১৫ জন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ২৫ জন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যেই দলের অভ্যন্তরে একের পর এক সংঘাত-হানাহানির ঘটনায় উদ্বিগ্ন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। বিশেষ করে, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড, নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা এবং দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার দগদগে ঘটনার মধ্যেই বিভিন্ন স্থানে দলের ভেতরে এই ধরনের সংঘাতে হতাহতের ঘটনা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে ভাবিয়ে তুলছে। এসব ঘটনার নেপথ্য কারণ খুঁজছে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান গতকাল ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, বিভিন্ন স্থানে উপনির্বাচন আছে; সামনে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি)সহ স্থানীয় সরকারের কিছু নির্বাচন আসন্ন—এসব কারণে হয়তো কিছু জায়গায় ছোটখাটো গোলমালের ঘটনা ঘটছে। দলীয়ভাবে বসে আমরা এ বিষয়ে নিশ্চয়ই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোগুলোর আরো তত্পর হওয়া দরকার। আগে থেকেই যেন এসব সংঘাতের ঘটনা আঁচ করা যায়, সেভাবে কাজ করতে হবে।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র বলছে, সামনে কয়েকটি সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন, পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনের সময় বিভিন্ন স্থানে দলের ভেতর বিরোধ আরো বাড়তে পারে। তাছাড়া এলাকায় প্রভাব বিস্তার ও বৈষয়িক স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণেও বিরোধ বা সংঘর্ষ হচ্ছে।

পাকুন্দিয়ায় রবিবারের সংঘাতের বিষয়ে জানা গেছে, উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-আহ্বায়ক ও বহিষ্কৃত উপজেলা চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম দলীয় সমর্থকদের নিয়ে উপজেলা সদরে আসছিলেন। থানা গেট পর্যন্ত আসতেই কিশোরগঞ্জ-২ (পাকুন্দিয়া-কটিয়াদী) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীরা অস্ত্র নিয়ে তাদের ধাওয়া করেন। ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হন। সংঘাতের সময় পাকুন্দিয়া উপজেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি নাজমুল হক দেওয়ানকে রাম দা হাতে অপর গ্রুপকে ধাওয়া করতে দেখা যায়। এ ঘটনায় আহত ইউএনও অফিসের কর্মচারী হাবিবুর রহমান বাদী হয়ে গতকাল পাকুন্দিয়া থানায় মামলা করেছেন।

ইত্তেফাকের ঈশ্বরদী সংবাদদাতা জানান, পাবনা-৪ আসনের আসন্ন উপনির্বাচন উপলক্ষ্যে গতকাল আয়োজিত ঈশ্বরদী উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় দুই গ্রুপের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে কয়েক জন নেতাকর্মী ছুরিকাহত হন। আহত হন অন্তত ১২ জন। এ ঘটনা সম্পর্কে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন জানান, ইতিমধ্যে ঈশ্বরদী যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত করতে জেলা কমিটিকে বলা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গত শুক্রবার পিরোজপুর শহরে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির বাড়ির বিয়ের আসর থেকে কনেকে অপহরণের চেষ্টার অভিযোগ ওঠে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে।

গত ৯ জুলাই টাঙ্গাইল শহরের ভিক্টোরিয়া রোডে শহর ছাত্রলীগের সদস্য ফাহিম খানের ওপর হামলা চালায় এক দল দুর্বৃত্ত। এ ঘটনায় ফাহিমের মা শহর আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক শাহিন আরা সদর থানায় শহর ছাত্রলীগের সভাপতি মীর ওয়াছেদুল হকসহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। গত ১০ সেপ্টেম্বর পুলিশ মীর ওয়াছেদুল হককে গ্রেফতার করে। এদিকে যশোরেও দলীয় কোন্দলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। যশোর সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান এবং জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বিপুল ৬ সেপ্টেম্বর স্থানীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, যশোর-৬ আসনের (কেশবপুর) আওয়ামী লীগের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছেন।

আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে, ২০১৬ সাল ছিল আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বেশি ভ্রাতৃঘাতী। এর মূল কারণ ছিল স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচন। ঐসব নির্বাচন শেষ হওয়ার পরবর্তী পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ছয় ধাপের ঐ ইউপি নির্বাচনে সারা দেশে তখন সহিংসতায় নিহত হন ১১৬ জন। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন ৭১ জন, যারা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে প্রাণ হারান। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) বার্ষিক প্রতিবেদনে তখন বলা হয়, ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে নিহত হন ৮৩ জন। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৩।

তার আগের বছর নিহত হন ৩৪ জন। সামগ্রিক রাজনৈতিক হানাহানি নিয়ে এবছরের শুরুর দিকে আসক-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, গত ছয় বছরে দেশে মোট ৬ হাজার ৭১০টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। তাতে নিহত হয়েছেন ৬৩৫ জন, আহত ৪১ হাজার ৩৪৫ জন। আসক-এর হিসাবে, শুধু ২০১৯ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৩৯ জন নিহত হয়েছেন, আহত হন ২ হাজার ৬৮৯ জন। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, ক্ষমতার মোহে হানাহানি বাড়বে—এটাই স্বাভাবিক। মাঠে যেহেতু অন্য কেউ নেই, তাই নিজেদের মধ্যেই একে অপরকে লক্ষ্যবস্তু করছে।

প্রজন্মনিউজ/এম.এইচ.টি

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ