ওসি প্রদীপের গ্রেফতারে শোকরানা নামাজ পড়েছেন অনেকে


 

বৃহস্পতিবার রাতে কারাগারে যাওয়ার পর শুক্রবার অন্য ৬ সহকর্মীর সঙ্গে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন বিতর্কিত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। র‌্যাব তাকে রিমান্ডে নিতে সময় পেয়েছে সাতদিন। সে হিসেবে সময়টা মোটেও অনুকূলে নেই বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপের।

এরপরও প্রদীপের গত দু’বছরে ফিল্মি স্টাইলে চালানো অপশাসনের ছায়া এখনও ভর করে আছে টেকনাফের সাধারণ মানুষের উপর। তার অর্ডারে চলা ‘টর্চার টিম’ এখনও বহাল থাকায় প্রদীপ আইনের ফাঁক গলে আবারও ওসি হয়ে আসতে পারেন এমন ভয়ে এখনও মুখ খুলছেন না অনেক ভুক্তভোগী। তবে সুযোগ এবং সহযোগিতা পেলে ভোগান্তি ও ক্ষতির বিচার চেয়ে মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন অনেক নিপীড়িত মানুষ।

তাদের মতে, প্রদীপ আমলের প্রায় দুই বছর রাত দূরে থাক দিনের বেলাতেও ঠিকটাক চলাফেরা করতে পারেননি হাজারও মানুষ। মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া না হওয়া কোনো বিষয় নয়, কখন কাকে কিভাবে তুলে নিয়ে গিয়ে টাকা আদায় কিংবা মাদক কারবারি তকমায় কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয় সে আতংক ছিল পুরো টেকনাফের ঘরে ঘরে। এমনটিই বলছেন সাধারণ মানুষ। তাই এখনও নির্যাতনের বিবরণ দিতে ভয় পাচ্ছেন অনেকে।

ওসি প্রদীপ আইনের ফাঁক গলে যদি আবার টেকনাফ আসেন বা তার অর্ডারে নিপীড়ন চালানো টিম এখনও থানায় বিদ্যমান থাকায় যেকোনো সময় বন্দুকের নলে পড়তে পারেন এমন আতংক তাদের ভর করে আছে।

প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফের ওসি হয়ে আসার পর দায়িত্বকালীন ২২ মাসে ১৪৪টি ক্রসফারের ঘটনা ঘটেছে বলে তথ্য এসেছে। এতে মারা গেছে ২০৪ জন। ক্রসফায়ারে নিহত সবাইকে দেয়া হয়েছে মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারের তকমা। অথচ সাধারণ মানুষ বলছে ক্রসফায়ারে নিহতদের বেশিরভাই ছিল নিরীহ মানুষ।

স্থানীয়রা বলছে, বিতর্কিত ওসি প্রদীপের কারান্তরীণ ও সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার খবরে টেকনাফজুড়ে হাজারো নির্যাতিত পরিবারে আনন্দ বইছে। স্বস্তি ফিরেছে মানুষের মাঝে। নিরাপত্তার পরিবর্তে প্রায় দুই বছরের অরাজকতার অবসান ও জিম্মিদশা থেকে মুক্তি মিলেছে ভেবে অনেকের চোখে ঈদ আনন্দ বিরাজ করছে। মেজর সিনহা হত্যা মালায় ওসি প্রদীপ আসামি হয়ে কারাগারে যাওয়ায় শোকরানা নামাজ ও দোয়া মাহফিল পড়িয়েছেন বলে জানিয়েছেন অনেকেই।

স্থানীয়দের দাবি সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার মাদক নির্মূলের নামে টেকনাফের মাদক ব্যবসায়ীদের এক প্রকার পুনর্বাসন করেছেন। কিছু কিছু ক্ষুদ্র মাদক পাচারকারিকে ক্রসফায়ার দিয়ে স্বার্থরক্ষা করা হয়েছে প্রদীপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ইয়াবা গডফাদারের। বিনিময়ে প্রদীপ পেয়েছেন কোটি কোটি টাকা। সরজমিন নিরপেক্ষ তদন্ত করলে যার সত্যতা মিলবে বলে দাবি ভুক্তভোগীদের।

অভিযোগ উঠেছে অনেকের স্বার্থে ব্যবহার হয়েছেন ওসি প্রদীপ। সম্প্রতি টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক নুরুল হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে চালানো একটি অভিযানে চেয়ারম্যানকেই মাদক মামলায় ফাঁসিয়েছেন ওসি প্রদীপ। অথচ মাদক নির্মূলে নুর হোসেনের ভূমিকা প্রশংসনীয় ছিল বলে দাবি তার পরিবার ও স্থানীয়দের।

অভিযোগ উঠেছে, আগামী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুবাই প্রবাসী ইসমাইল নামে একজনকে চেয়ারম্যান বানানোর কন্ট্রাক্ট নিয়ে ওসি প্রদীপ বর্তমান চেয়ারম্যানকে মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে নির্বাচনের আগেই ক্রসফায়ারে নেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন।

ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে প্রায় দুই বছর ধরে লাখ লাখ টাকা আদায়, কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে ইয়াবা পাচারকারীদের নির্মূল করে বড় মাদক কারবারিদের রেহাইয়ের সুযোগ করে দেয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে হয়রানি, নির্যাতন ও লুটপাটের পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে রয়েছে থানায় আটকে রেখে নারীদের উপর নিপীড়ন চালানোর অভিযোগও। বন্দুকযুদ্ধের নামে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে ধামাচাপা দিয়ে গেছেন অভিযোগের পাহাড়।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় গ্রেফতারের পর ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগীরা। অথচ কয়েকদিন আগেও ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত স্বজনের লাশ কাঁধে নিয়েও কান্নার পরিবর্তে ওসি প্রদীপের পক্ষে সাফাই গাইতে তারা বাধ্য হয়েছিলেন বলে দাবি তাদের। এখন সেসব ঘটনার প্রতিকার পেতে আদালতের শরণাপন্ন হতে চান ভুক্তভোগীরা।

গত বৃহস্পতিবার (৬ আগস্ট) ওসি প্রদীপকে আটকের খবরে টেকনাফ থানার সামনে জড়ো হয় শত শত মানুষ। সেখানে উপস্থিত হন শতাধিক ভুক্তভোগী। তারা ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা আদায় ও ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর ঘটনা সবার সামনে বলেন। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে মামলা করার কথাও জানান তারা।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, টেকনাফ হোয়াইক্যং এলাকার আনোয়ার নামের এক ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে গিয়ে অর্ধকোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন ওসি প্রদীপ। টাকা দিতে না পারায় তিনদিন পর কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে তাকে হত্যা করা হয়।

এ বিষয়ে প্রতিকার পেতে নিহতের মেয়ে এবং বোন কক্সবাজার আদালতে যান। খবর পেয়ে ওই দুই নারীকে তুলে নিয়ে যান ওসি প্রদীপের লোকজন। তাদের থানায় আটকে রেখে টানা নিপীড়নের পর ইয়াবা দিয়ে চালান দেয়ার অভিযোগ ওঠে।