রিজেন্ট-জেকেজির করোনা সনদে মিলবে না সরকারি ক্ষতিপূরণ

প্রকাশিত: ১৩ জুলাই, ২০২০ ০৮:১৩:৫৬

রিজেন্ট-জেকেজির করোনা সনদে মিলবে না সরকারি ক্ষতিপূরণ

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো তিনজনের শরীরে শনাক্ত হয় মরণব্যাধী করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। শনাক্তের কয়েকদিন পরেই ভাইরাসটির সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে সরকার কয়েক ধাপে ৬৬ দিন সাধারণ ছুটিও ঘোষণা করে। কিন্তু সাধারণ ছুটিতে ও এর পরবর্তী সময়েও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসনসহ মাঠপর্যায়ের কর্মীরা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

এমন পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরিজীবীদের কাজে উদ্বুদ্ধ করতে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল- কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হলে ক্ষতিপূরণ বাবদ গ্রেডভেদে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা পাবেন। আর মারা গেলে পাবেন ২৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা। তবে এ ক্ষতিপূরণ পাওয়ার লোভে দুর্নীতিগ্রস্ত রিজেন্ট হাসপাতাল ও জোবেদা খাতুন সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা তথা জেকেজি হেলথকেয়ারসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থের বিনিময়ে কোভিড-১৯ পজিটিভের সার্টিফিকেট সংগ্রহের হিড়িক পড়ে যায়।

কিন্তু করোনা পরীক্ষা নিয়ে রিজেন্ট ও জেকেজির অনিয়মের বিষয়টি সামনে আসার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে- যারা লোভে পড়ে ভুয়া সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে অর্থের আবেদন করছেন, তারাও কি ক্ষতিপূরণ পাবেন? অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে- না, এসব (রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি হেলথকেয়ার) দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে ভুয়া সার্টিফিকেট যারা নিয়েছেন বা নিচ্ছেন তারা কোনোভাবেই ক্ষতিপূরণ পাবেন না। এমন কী আর কিছুদিন দেখার পর এ ক্ষতিপূরণ দেয়াটাও বন্ধ করে দেয়ার কথা ভাবছে অর্থ বিভাগ।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই ক্ষতিপূরণ যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করে দেয়া উচিত। কারণ এ ক্ষতিপূরণের লোভে হাজার মানুষ ভুয়া করোনা পজিটিভ সনদ সংগ্রহ করছেন। তাছাড়া সবার জীবনই খুব মূল্যবান। তাহলে শুধু সরকারি চাকরিজীবীরাই শুধু এ সুবিধা পাবে কেন?

ইতোমধ্যেই ঢাকার রিজেন্ট হাসপাতাল করোনার হাজার হাজার ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এমনকি নমুনা সংগ্রহ না করেই কিংবা পরীক্ষা না করেই মনগড়া রিপোর্ট দেয়ার প্রমাণ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একই অভিযোগের সত্যতা মিলেছে জেকেজি হেলথকেয়ারের বিরুদ্ধেও।

অর্থ বিভাগের যুগ্মসচিব সিরাজুন নূর চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের প্রাথমিক চিন্তা হচ্ছে, যারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তাদের ক্ষতিপূরণ আগে দেয়া হবে। ক্ষতিপূরণের প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়েছিল এপ্রিলে, তখন প্রেক্ষাপট অন্যরকম ছিল। এসব ক্ষেত্রেও যে এ ধরনের ভুয়া সার্টিফিকেট দেয়ার বিষয়টি আসবে, এগুলো তো জানা ছিল না। এখনও আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়া শুরু হয়নি। ক্ষতিপূরণ দেয়ার ক্ষেত্রে আবেদনপত্র কঠোরভাবে যাচাই-বাছাই করা হবে।’

তিনি বলেন, ‘কোভিড পজিটিভের সার্টিফিকেট দিলেই তো সে আর ক্ষতিপূরণের জন্য যোগ্য হবে না। কারণ একবার কেউ পজিটিভ হলে নির্দিষ্ট সময়ে পর পর দুইবার নেগেটিভের সার্টিফিকেটও দিতে হবে। সুতরাং কেউ যদি ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে আসে এ ক্ষেত্রে ধরাও পড়বে। তাছাড়া যারা এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠান (রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি হেলথকেয়ার) থেকে সার্টিফিকেট নিয়েছে তাদেরকে নিশ্চয় ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না।’

বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে প্রায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে, তাহলে ক্ষতিপূরণ কি স্থগিত করে দেয়া উচিত নয়- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এখনও ওইরকম চিন্তা করা হয়নি। কারণ সব খুলে দেয়া হলেও ভয়াবহতা তো এখনও কমে আসেনি। আরও কিছুদিন দেখার পর হয় তো এই মাসের (জুলাই) শেষের দিকে স্থগিত করা যায় কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’

এ বিষয়ে ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হলে কিছু দেয়াটাও চলে। কিন্তু শুধু আক্রান্ত হলেই ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ, এটার কোনো মানে নেই। তখনই আমি বলেছিলাম, যখন পরে শত শত আক্রান্ত হবে তখন এটা দেয়া সম্ভব হবে না। তাই এটা যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করে দেয়া উচিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘যখন ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করা হয়, তখনই বলেছিলাম, এ অর্থের লোভে ভুয়া কোভিড পজিটিভ সার্টিফিকেটের হিড়িক পড়বে। এখন তাই হয়েছে। জীবনতো সবারই দামি, সরকারি চাকরিজীবীদের তো এটা ডিউটি। তাহলে তারা কেন আলাদাভাবে এ সুবিধা পাবে? তারা পেলে একজন সাধারণ মানুষের তো পাওয়া উচিত। আমি মনে করি, একমাত্র চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়া এটা আর কারও পাওয়া উচিত নয়।’

এদিকে শুরু থেকেই করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন সরকারি চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসনসহ মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের মধ্যে কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে ক্ষতিপূরণ বাবদ গ্রেডভেদে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং মারা গেলে ২৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা দেয়ার ঘোষণা ইতোমধ্যে দিয়েছে সরকার।

এ বিষয়ে গত ২৩ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্রে বলা হয়, ‘করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদানে সরাসরি কর্মরত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ এ সংক্রান্ত সরকার ঘোষিত নির্দেশনা বাস্তবায়নে মাঠ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী ও প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মচারী দায়িত্ব পালনকালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে ক্ষতিপূরণ বাবদ সরাসরি আর্থিক সুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।’

ওই পরিপত্রে আরও বলা হয়, ২০১৫ এর বেতন স্কেল অনুযায়ী, ১৫-২০তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে তিনি ক্ষতিপূরণ পাবেন পাঁচ লাখ, মারা গেলে পাবেন ২৫ লাখ টাকা। ১০-১৪তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে পাবেন সাড়ে সাত লাখ এবং মারা গেলে সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। এছাড়া প্রথম-নবম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে পাবেন ১০ লাখ এবং মারা গেলে ৫০ লাখ টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি প্রশাসনের মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ যারা প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের সবার জন্য স্বাস্থ্যবীমার কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু বীমার ক্ষেত্রে সরকারকেই প্রিমিয়াম দিতে হবে। এছাড়া বীমার টাকা পেতে আইনি প্রক্রিয়া শেষ করতে অনেক সময় লেগে যায়। তাই মাঠপর্যায়ে যারা কাজ করছেন তাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে সরাসরি আর্থিক সহায়তা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে-

করোনাভাইরাস পজিটিভের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মীসহ মাঠ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী এবং প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনাভাইরাস পজিটিভের প্রমাণ বা মেডিকেল রিপোর্টসহ নিজ নিজ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে নির্দিষ্ট ফরমে ক্ষতিপূরণের দাবিনামা জমা দেবেন।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ফরমে মৃত্যুবরণকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্ত্রী/স্বামী/সন্তান এবং অবিবাহিতদের ক্ষেত্রে বাবা/মা ক্ষতিপূরণের দাবি-সংবলিত আবেদন নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেবেন।

নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ আবেদনপত্রসমূহ যাচাই-বাছাই করে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় বা বিভাগের মাধ্যমে অর্থ বিভাগে প্রস্তাব পাঠাবে।

প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত কর্মচারীরা কেবল এ ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য হবেন।

ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্যয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সৃজনকৃত খাতে করোনা (কোভিড-১৯) সংক্রান্ত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় ক্ষতিপূরণ বরাদ্দকৃত অর্থ হতে নির্বাহ করা হবে। অর্থ বিভাগ ক্ষতিপূরণের আবেদনপ্রাপ্তির পর ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদানের সরকারি আদেশ জারি করবে।

এ ক্ষতিপূরণ বর্তমানে প্রচলিত অন্য যেকোনো প্রজ্ঞাপন/আদেশে বর্ণিত কর্মকালীন মৃত্যুবরণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আর্থিক সহায়তা বা অনুদানের অতিরিক্ত হিসেবে প্রদেয় হবে। চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে এ পরিপত্রের নির্দেশনা কার্যকর হবে।

এছাড়া করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগীদের সরাসরি চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন এমন ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ প্রণোদনা হিসেবে অতিরিক্ত দুই মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ এককালীন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।

গত ৯ জুলাই এ সংক্রান্ত একটি পরিপত্র জারি করে অর্থ বিভাগ। যুগ্ম সচিব ড. মোহাম্মদ আবু ইউছুফ স্বাক্ষরিত পরিপত্রে বলা হয়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদানে সরাসরি নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সরকার এককালীন বিশেষ সম্মানী প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

বিশেষ সম্মানীর আওতায় শুধু করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদানে সরাসরি কর্মরত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মীরা এককালীন দুই মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পাওয়ার যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন।

এছাড়াও ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালুর কথাও ভাবছে সরকার।

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন





ব্রেকিং নিউজ