‘ডিজিটাল ডিভাইড’ প্রতিরোধ করা এখনই দরকার

প্রকাশিত: ২৬ জুন, ২০২০ ০৯:১৫:১৩

‘ডিজিটাল ডিভাইড’ প্রতিরোধ করা এখনই দরকার

সমাজবিজ্ঞানীরা প্রতিদিনই করোনা-পরবর্তী সমাজ পরিবর্তনের নানা সম্ভাবনার পূর্বাভাস দিয়ে চলেছেন। ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ বা ‘ডিজিটাল বৈষম্য’ সে রকমই একটি পরিবর্তনের বিপজ্জনক ধারা হয়ে উঠতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অত্যন্ত সহজ ভাষায় বলতে গেলে ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ সেটিই, যেখানে এক দল ইন্টারনেটের সব সুবিধা হাতের নাগালে পাচ্ছে, অন্য দল সামান্যই পাচ্ছে অথবা একেবারেই পাচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, করোনা পরীক্ষার জন্য অনলাইনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার সাধ্য নেই গ্রামগঞ্জের ৭৫ ভাগ মানুষের। ফোনের সাধারণ ব্যবহার জানলেও অনেকের কম্পিউটার নেই, ইন্টারনেট সংযোগ নেই বা অনলাইন ব্যবহার জানেন না। সহায়তাকারী দালালেরা এই সুযোগে অনেককে বিভ্রান্ত করছে। খবর হয়েছে অনেক মানুষ অ্যাপয়েন্টমেন্ট অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে আসার বদলে মধ্যরাত থেকে বিএসএমএমইউয়ের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁদের বুঝিয়েও ফেরত পাঠাতে পারেননি। কাগজ কিংবা মাদুর বিছিয়ে শুয়ে ছিলেন অনেকে।

খবর হয়েছে বাংলাদেশে ইন্টারনেটভিত্তিক পাঠদানে পার্বত্য এলাকার এবং দূর পাড়াগাঁয়ে ৯০ ভাগ ছাত্রছাত্রী সরাসরি বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। একটি সমস্যা ইন্টারনেটের দুর্বল ও অস্থিতিশীল সংযোগ এবং গতিহীনতা। আরেকটি সমস্যা দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের অনেকেরই কম্পিউটার দূরে থাকুক, স্মার্টফোনও নেই। অনেক ছাত্রের অনলাইন ডেটা কেনার মতো আর্থিক সংগতি নেই। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ইন্টারনেটভিত্তিক ক্লাস বর্জনের আন্দোলন শুরু করেছেন। প্রত্যন্ত গ্রামে ফিরে যাওয়া দরিদ্র ছাত্রটির জন্যও শিক্ষা সুযোগ নয় অধিকার। দারিদ্র্য তাঁর অপরাধ নয়। তাই বৈষম্য ও বঞ্চনার মতো শাস্তিও তাঁর প্রাপ্য নয়।

 

এগুলো নিতান্তই প্রাথমিক পর্যায়ের ডিজিটাল ডিভাইড বা ডিজিটাল বৈষম্য। করোনা-পরবর্তী এই বৈষম্য বহুগুণ বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে। সব মানুষের অভিযোজন ক্ষমতার সঙ্গে সংগতি রেখে প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি সিংহভাগ মানুষকে জোর করেই প্রযুক্তি গ্রহণে বাধ্য করছে—কুইনাইন গ্রহণের মতো। অস্বস্তিকর এই অবস্থা মনে করিয়ে দেয় সৈয়দ মুজতবা আলীর রসোক্তি, ‘কুইনাইন জ্বর সারাবে বটে, কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে?’

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম এপ্রিল মাসে জানিয়েছে যে বিশ্বে ৫৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী, অর্থাৎ ৩৭৫ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা পায় না। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ৪৭ শতাংশ মানুষের ইন্টারনেট সংযোগ নেই। বাংলাদেশও উন্নয়নশীল দেশ। এলডিসি বা অনুন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে মাত্র ১৯ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেটে যুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেই ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে না। ইউনেসকো জানাচ্ছে, ২০২৫ সাল নাগাদ অন্তত ৭৫ শতাংশ গৃহে ব্রডব্যান্ড সুবিধা নিশ্চিত করা না গেলে বিপুলসংখ্যক শিশু অনলাইন পাঠদানের সুবিধার বাইরে ছিটকে পড়বে। সংস্থাটি জানায়, ফেব্রুয়ারিতেই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু হলেও এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বে ১০০ কোটি শিশুকে বঞ্চিত হতে হয়। সাব-সাহারান আফ্রিকায় ইন্টারনেটের অগ্নিমূল্য সেখানকার জনগোষ্ঠীকে আরও কয়েক যুগ ইন্টারনেটবঞ্চিত রাখবে। তারপর আছে নারী-পুরুষ বঞ্চনা। ইন্টারনেট ব্যবহারে নারীরা পুরুষের চেয়ে ২৩ শতাংশ পিছিয়ে। একই সময়ে আঙ্কটাড ২০১৯ সালের রিপোর্টের ভিত্তিতে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে যে বিশ্বে ডিজিটাল ডিভাইড মারাত্মক হয়ে উঠবে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র হবে সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী। চীনে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে ঘরে বসে কাজ করা অ্যাপস ও সফটওয়্যার উৎপাদন বেড়েছে সাধারণ সময়ের প্রায় ৭০০ গুণ বেশি।

সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে এই অভিমত এখন অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত যে করোনা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ত্বরান্বিত করবে। সামর্থ্যবান মানুষকে বাধ্য হয়েই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত রোবটের সহায়তা নিতে হবে। তাঁরা পূর্বাভাস দিচ্ছেন যে মিথস্ক্রিয়া বা সরাসরি এবং মুখোমুখি আড্ডা, বহু মানুষ-সহযোগে সামাজিকতা এবং বড়সড় জমায়েত কমবে। ছড়ানো-ছিটানো বৃহত্তর গণ্ডি থেকে মানুষ ক্ষুদ্র গণ্ডি, যেমন গৃহেই বেশি সময় ব্যয় করবে। কারণ, বয়স্ক ও পুরুষ মানুষের সংখ্যা কমবে এবং শিশু-কিশোরেরা সংখ্যায় বাড়বে। উঠতি বয়সীদের নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশে বড় করার দরকার হবে। কিন্তু স্বল্প বয়সী হওয়ায় জীবন-জীবিকার বা আয়-উপার্জনের জন্য অর্থনীতির কেন্দ্র আঁকড়ে থাকার জন্য তাদের চির-শহরবাসী থাকার চাপ নিতে হবে না। অর্থনীতির আগ্রাসী গতিও থাকবে না। রাষ্ট্রগুলো গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশে অধিক মনোযোগী হবে। ফলে মানুষ শহরের কোলাহল ছেড়ে গ্রামমুখী হতে চাইবে।

শিক্ষা বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত যে অর্থের দারুণ সাশ্রয় হয় বলে শিক্ষাপ্রযুক্তি ইন্টারনেটনির্ভর ও দূরশিক্ষণভিত্তিক হয়ে পড়বে। সেই নমুনা এখনই স্পষ্ট। অনলাইনভিত্তিক পাঠও শিক্ষাগ্রহণের জন্য নিত্যনতুন সুবিধাসেবা-সংযুক্ত উন্নত মানের সফটওয়্যার বাজারে আসছে। প্রতিদিনই প্রতিযোগিতামূলকভাবে একটি থেকে আরেকটি উন্নততর সফটওয়্যার মিলছে। শিক্ষা-সহযোগী রোবট উৎপাদিত হচ্ছে। ধনীরা গ্রামে গিয়েও এসব প্রযুক্তির সব সুবিধাই পাবে। কিন্তু বিপদে পড়বে ক্রয়ক্ষমতাহীন দরিদ্ররা। আর্থিক ও মানসিক সক্ষমতাহীন সুবিশাল সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর আত্মম্ভরিতা, বিরক্তি, কৃপা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হবে।

ডিজিটাল ডিভাইড চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবায় বিপজ্জনক বিপর্যয়টি ঘটাতে পারে। দরিদ্রদের স্বাস্থ্যসেবা-বঞ্চনা ও রোগশোকজনিত মৃত্যু বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার এই আশঙ্কা ব্যক্ত হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর উন্নত চিকিৎসা ও সেবা-ব্যবস্থার সক্ষমতার ওপর মানুষের যে অগাধ বিশ্বাস ছিল, করোনার তাণ্ডবে সেই বিশ্বাস ভেঙে পড়েছে। মানুষ ছোঁয়া চায়, আলিঙ্গন ও সংস্পর্শ চায়। ভালোবাসা চায়। কিন্তু করোনা অসংখ্য মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে যে ছোঁয়াচে রোগের কবলে পড়লে তাদের কপালে প্রিয়জনের সেবা বা প্রিয় মানুষের সহানুভূতিময় মায়া-মমতার স্পর্শ নাও জুটতে পারে। ফলে মানুষ অধিক সক্ষম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রের কাছ থেকে সেবা পাওয়ার কথা ভাবছে। গৃহস্থালি কর্মের রোবটের পাশাপাশি চিকিৎসা এবং ব্যক্তিপর্যায়ে শুশ্রূষাদানকারী রোবটের প্রয়োজনীয়তাকে মাথায় রেখে উৎপাদনও শুরু হয়ে গেছে। সেগুলো বাজারে আসতেও বেশি সময় লাগবে না। জটিল প্রযুক্তিনির্ভর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাধারী যন্ত্রের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবার সুযোগটি ধনীরাই নেবে। কোনোই সন্দেহ নেই যে ডিজিটাল ডিভাইড স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্যকে আরও সুগভীর করে তুলবে।

সমাজকাঠামোর অন্তর্গত বৈষম্য দূর করার আগেই উন্নততর প্রযুক্তি গ্রহণ করা বিপজ্জনক। বিশ্বনেতৃত্ব সমস্যাটির আসন্ন ভয়াবহতাকে আমলে নিয়ে একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলুক। বাংলাদেশেরও এদিকে অচিরেই নজর দেওয়া দরকার। নইলে করোনা-পরবর্তী পরিবর্তিত সমাজে ইন্টারনেট ব্যবহারের বৈষম্যকে কেন্দ্র করেই সমাজ–সম্পর্কে ভাঙন ও শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি হতে পারে।

হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান। গবেষক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।

প্রজন্মনিউজ২৪/মারুফ

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



A PHP Error was encountered

Severity: Notice

Message: Undefined index: category

Filename: blog/details.php

Line Number: 417

Backtrace:

File: /home/projonmonews24/public_html/application/views/blog/details.php
Line: 417
Function: _error_handler

File: /home/projonmonews24/public_html/application/views/template.php
Line: 199
Function: view

File: /home/projonmonews24/public_html/application/controllers/Article.php
Line: 87
Function: view

File: /home/projonmonews24/public_html/index.php
Line: 315
Function: require_once

বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ