লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশি হত্যা


লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ জন অভিবাসী হত্যার ঘটনায় আমরা মর্মাহত। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই। ভাগ্যান্বেষণে দেশছাড়া বাংলাদেশি তরুণদের এমন নির্মম মৃত্যু ও করুণ পরিণতি সত্যিই অসহনীয়।

সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ থেকে ৩৮ জন তরুণ ভারত ও মিসর হয়ে লিবিয়ায় যান। সেখান থেকে ইতালিতে যাওয়াই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। কিন্তু সুদানের আরও কয়েকজন নাগরিকের সঙ্গে এই বাংলাদেশি তরুণেরাও লিবিয়ায় দুই দফা অপহরণের শিকার হন। প্রথম দফা অপহরণের পর মুক্তিপণ দিয়ে তাঁরা ছাড়া পান। দ্বিতীয় দফায় চাহিদামাফিক অর্থ দিতে না পারায় অপহরণকারীরা তাঁদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। একপর্যায়ে তাঁরা অপহরণকারী দলের হোতাসহ দুজনকে হত্যা করেন। এই হত্যার প্রতিশোধ নিতে অপহরণকারীরা নির্বিচারে জিম্মিদের ওপর গুলি চালালে ২৬ জন বাংলাদেশি ও ৪ জন সুদানি নিহত হন। লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও লিবিয়া সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে হত্যার প্রতিকার ও ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে।

রাজনৈতিক গোলমালের কারণে ২০১৫ সাল থেকে লিবিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ আছে। তারপরও সেখানে বাংলাদেশিদের যাওয়া বন্ধ নেই। পাচারকারীরা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই মানব পাচারের অন্যতম উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশ মানব পাচারের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত।

দেশে মানব পাচারবিরোধী আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। এ ছাড়া আইনে বিস্তর ফাঁকফোকর রয়ে গেছে। সিলেটে কয়েকজন পাচারকারীর বিরুদ্ধে মামলা করলেও তারা জামিন পেয়েছে। পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে অনেক ভাগ্যান্বেষী তরুণ বিদেশে দুর্বিষহ জীবন বেছে নিতে বাধ্য হন। অনেকে দুর্ঘটনায় মারা যান। কয়েক বছর আগে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় যে গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছিল, সেখানেও বেশ কিছু বাংলাদেশির কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় লিবিয়া সরকারের কাছে বাংলাদেশি হত্যাকাণ্ডের ক্ষতিপূরণ এবং অপরাধীদের বিচার দাবি করেছে। এতে আদৌ কোনো ফল মিলবে কি না, সেটা এক বড় প্রশ্ন। আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে দেশীয় মানব পাচারকারী চক্রকে নির্মূল করা। সেটা করতে না পারার কারণেই এসব ঘটনা অব্যাহতভাবে ঘটে চলেছে। দেশীয় পাচারকারী চক্রের সক্রিয় উদ্যোগ ও তৎপরতা ছাড়া তরুণেরা ভয়াবহ বিপৎসংকুল এই অবৈধ পথ বেছে নিতে উৎসাহিত হতেন না।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এ ধরনের হত্যা বন্ধ হবে না। কিন্তু কাজটি করবে কে? সরকার বিদেশি পাচারকারী চক্রের নাগাল না পেতে পারে, কিন্তু দেশীয় পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না কেন? মানব পাচার রোধে আইন পাস হওয়ার পর বিধি জারি হতে কেন সাত বছর লাগল? কেন পৃথক আদালত বসানো গেল না? এর জবাব কে দেবে?

বৈধ কিংবা অবৈধ—যে পথেই বাংলাদেশিরা বিদেশে যান না কেন, তাঁদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের অর্থনীতির বড় শক্তি। রেমিট্যান্স আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়ে সরকারের সেই মাত্রায় তৎপরতা দেখা যায় না।

 মানব পাচারের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। এটা আমাদের জন্য লজ্জার। মানব পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি এর বিপদ সম্পর্কে জনসচেতনতাও বাড়াতে হবে। কোনো অঘটন ঘটলেই সংশ্লিষ্ট মহলকে সাময়িক তৎপর হতে দেখা যায়। কিন্তু বিপজ্জনক ও ভয়ংকর এই মানব পাচারের বিরুদ্ধে সার্বক্ষণিক ও সর্বাত্মক তদারকি জারি রাখার কোনো বিকল্প নেই। 

projonmonews24/maruf