ইসলামে মহামারীতে করণীয়ঃ আমাদের আলেম সমাজ

প্রকাশিত: ০৪ এপ্রিল, ২০২০ ০৭:৫৮:০৮

ইসলামে মহামারীতে করণীয়ঃ আমাদের আলেম সমাজ

ইসলাম সবচেয়ে আধুনিক ধর্ম। আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা:) সর্বশেষ নবী। এজন্য তিনি মানবজাতির জন্য সবচেয়ে আধুনিক জীবনবিধানই আমাদের জন্য দিয়ে গেছেন। তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন আল্লাহ কোরআন ও তার জীবনের অভিজ্ঞতা নির্যাস বা হাদিস। ধর্মকে সরাসরি বুঝতে গেলেই যতো বিপত্তি; তাকে বুঝতে হয় দার্শনিক কায়দায়। তাই শুধু কোরআন মুখস্থ করলেই তাকে আমরা ধর্মের জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ বলতে পারি না। ধর্মকে বুঝতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে কোন প্রেক্ষিতে বানীটা এসেছে।

ধরুণ, মহামারী। এ সম্পর্কে তিনি সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট কর্মপ্রণালী বলে গেছেন।

"সিরিয়ায় মহামারী দেখা দিলে হযরত ওমর (রা:) তার গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সফর স্থগিত করেন। (বোখারী, হাদিস নম্বর: ৫৭২৯)

উপর্যুক্ত হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারি কোন এলাকায় যদি মহামারী দেখা দেয় তবে যতো দরকারি কাজই হোক না কেন সে এলাকায় প্রবেশ না করা। ইসলামের প্রথম যুগে কূটনৈতিক সফর খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো কিন্তু মহামতি ওমর মহামারীর জন্য সে সফরও বাতিল ঘোষণা করেন।

"কোন ব্যক্তি যেন তার অসুস্থ উটকে সুস্থ উটের কাছে না নিয়ে যায়।" (বোখারী, হাদিস নম্বর: ৫৭৭১. মুসলিম, নম্বর: ১৭৪৩)

"কুষ্ঠরোগী থেকে সেভাবে পালাও যেভাবে সিংহ থেকে পলায়ন করো।" (সহিহ বোখারী)

উপর্যুক্ত দুইটা হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারি, অসুস্থ উট থেকে সুস্থ উট কে আলাদা করা নইলে সুস্থ উটটাও অসুস্থ হয়ে যাবে। অন্যদিকে মানুষের সামান্য একটু কষ্টেও তিনি কাতর হয়ে পড়েন কিন্তু কুষ্ঠ রোগী দেখে তিনি পলায়ন করতে বলেছেন কারণ কুষ্ঠরোগীর সংস্পর্শে এলে সংস্পর্শকারী নতুন করে আক্রান্ত হয়ে পড়বে। এতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে। মানে রোগটা ছোঁয়াচে। তাই তা থেকে পলায়ন করো। শুধু পলায়ন নয় অতিদ্রুত। এবং সিংহ থেকে যেভাবে পলায়ন করো। মানে হিংস্র জন্তুর থেকে আমরা জীবন বাচাতে পলায়ন করি তেমন করে পলায়নের কথা বলা হয়েছে।

"কোথাও মহামারী দেখা দিলে এবং তোমরা সেখানে অবস্থান করলে সে স্থান থেকে বাইরে এসো না। এবং সে জায়গায় বাইরে থেকে কেউ প্রবেশ করো না।" (তিরমিজি, হাদিস নম্বর: ১০৬৫)

এ হাদিসে মহামারী দেখা দিলে যে যেখানে থাকবে সেখানেই অবস্থানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমরা এখন যাকে লকডাউন বলছি। ১৪০০ বছর আগে হযরত মূলত সে কথাই বলেছেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে হারেস থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন- "এক বর্ষণমুখর দিনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) মুয়াজ্জিনকে বললেন- যখন তুমি (আযান) আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ" বলবে, তখন- হাইয়াআল্লাস্ সালাহ বলবে না। বলবে, সল্লু ফি বয়ূতিকুম (তোমরা নিজ নিজ গৃহে সালাত আদায় করো)।

তা অনেকে অপছন্দ করলেন। তখন তিনি বললেন- আমার চেয়ে উত্তম ব্যক্তি (হযরত) তা করেছেন।

জুম'আ নি:সন্দেহে জরুরি। আমি অপছন্দ করি যে, আপনাদেরকে মাটি ও কাদার ভেতর দিয়ে যাতায়াত করার অসুবিধায় ফেলি।" (বোখারী, হাদিস নম্বর: ৯০১; মুসলিম, হাদিস নম্বর: ৬৯৯)

"যদি কেউ ভয়ভীতি ও অসুস্থতার কারণে জামাতে উপস্থিত হতে না পারে তবে তার জন্য বাড়িতে নামাজ পড়া দূষণীয় নয়।" (সুনানু আবি দাউদ, হাদিস নম্বর: ৫৫১)

উপর্যুক্ত হাদিসে আমরা দেখতে পাই, বিশেষ পরিস্থিতিতে মসজিদের বা ঘরে নামাজ পড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সামান্য ঝড় বৃষ্টিতেই নামাজ ঘরে পড়ার কথা বলা হয়েছে, সেখানে মহামারী হলে তো কথাই নেই। অবশ্যই ইসলাম ঘরেই নামাজ পড়তে বলবে। কিন্তু আমাদের আলেম ওলামার এসব মানছে না কেন?

কারণ মোল্লাতন্ত্র। মোল্লাতন্ত্র হলো কোনো বিষয় বা ঘটনার বিশ্লেষণ না করতে পারা। প্রচলিত মতকেই প্রধান মনে করা। এটা এক ধরনের আবেগ এবং নির্বুদ্ধিতা। ইসলামে আবেগ, কল্পনা ও নির্বুদ্ধিতার কোন স্থান নেই।

এবার আমরা একটু পেছনে ফিরে যাই, ৪৪৮ হিজরির ভয়াবহ মহামারি নিয়ে লিখতে গিয়ে ইমাম আদ দাহাবি (রহ.) লিখেছিলেন, মিশর আর আন্দালুসে এমন এক প্লেগের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল যা মানুষ আগে কখনো দেখেনি। এ এমন এক ভয়াবহ দুর্যোগ ছিল যে কোনো মুসল্লি না থাকার কারণে মসজিদগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এবং আলেমগণ গণজমায়েত করে দোয়ার আয়োজন করেছিলেন। এতে মহামারী আরো প্রবল বৃদ্ধি পেয়েছিলো।

দিল্লীতে তাবলীগ জামাতের জমায়েতের জন্য যে বিপুলসংখ্যক মসুলমান আক্রান্ত হলো এর দায় কে নেবে? ইসলাম? না তা মোটেই নয়। ইসলাম কিন্তু তা কখনোই বলে না বা বলতে পারে না। ইসলামে কোন কুসংস্কারের জায়গা নেই।

৭৭৯ হিজরিতে আল মাক্বরিজি লিখেছেন, এ এক এমন ভয়াবহ মহামারি ছিল যে মসজিদগুলোতে আজান দেয়ার মতো কেউ ছিল না। বেশিরভাগ মসজিদই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আলেমগণ সিদ্ধান্ত নিলেন, শহরের বাইরে গিয়ে সবাই জমায়েত হয়ে সম্মিলিতভাবে দোয়া করবেন। কিন্তু এর ফল হলো ভয়াবহ। আরও দ্রুত ছড়াতে শুরু করল প্লেগ। মৃত্যুহার বেড়ে গেল জ্যামিতিক হারে।

৮৩৩ হিজরিতে আবার প্লেগ শুরু হলো কায়রোতে। প্রতিদিন প্রায় ৪০ জন আক্রান্ত হতে লাগলো। আবার আলেমগণ জমায়েত হয়ে দোয়ায়ে শিফার আয়োজন করলেন। কিন্তু ফলাফল ভয়াবহ। পরবর্তী সপ্তাহে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা হাজার ছাড়ায়ে গেলো।

দেখা যাচ্ছে এরকম দোয়া আল্লাহ কবুল না করে আরো ভয়াবহ শাস্তি দিচ্ছেন। এর কারণ কি এই নয় যে আল্লাহ তো বহু আগেই প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা:) এর মাধ্যমে করণীয় ঠিক করে দিয়েছেন। নতুন করে কোন পন্থা অবলম্বন করা আমাদের উচিৎ হবে না।

এবার বাংলাদেশে একশ্রেণির আলেমদের কর্মপ্রণালী কেমন সেটা জেনে নেই। এরা কোন নতুন কিছুই মানতে পারে না বা কিভাবে নতুন বিষয় গ্রহণ করতে হয় তা জানে না।(অবশ্যই সকল আলেমদের বলা হচ্ছে না)

স্মরণ করি-১. যখন আমাদের দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এলো তারা ফতোয়া দিলো। 'মুখ দিয়েছেন যিনি আহার দিবেন তিনি' মানে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি মানা হারাম। কিন্তু এখন তারা সেটা মেনে নিয়েছেন। তবে ১০ বছর পর। তারা যে মেনেছে তার প্রমাণ আপনি পাবেন, তাদের ঘরে তাদের সন্তানের সংখ্যা দেখে।

স্মরণ করি-২. ছবি তোলা হারাম। এ ফতোয়া তারা দিয়েছেন দীর্ঘ দিন। এমনকি জামায়েতে ইসলামী ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে তারা তাদের নির্বাচনী পোস্টারে শুধু দাঁড়িপাল্লা মার্কা দিয়ে পোস্টার করলেন। প্রার্থীর ছবি ব্যবহার করলেন না। কারণ কি? তারা বললেন- ছবি তোলা হারাম। কিন্তু তার পরের নির্বাচনে তারা ছবি ব্যবহার করলেন। টিভি দেখা হারাম পরে তারা টিভির মালিক হলেন। এমন করে আমি অন্তত ৫০ টা উদাহরণ দিতে পারবো এতে লেখার কলেবর বাড়বে।

এবার করোনা নিয়ে আমাদের আলেমদের কিছু কথা উল্লেখ করে লেখা শেষ করবো।

আমির হামযা নামক একজন বললেন- বাংলাদেশে করোনা আসবে না যদি আসে কোরআন মিথ্যা হয়ে যাবে কিন্তু আমরা কি দেখলাম?

কাজী ইব্রাহীম নামক আর একজনকে দেখলাম তিনি ধারাবাহিকভাবে স্বপ্ন বলে যাচ্ছে। যে স্বপ্ন তিনি দেখেননি, দেখেছেন মামুন মারুফ নামক জনৈক যুবক।

ইসলামের নামে কি সব হালকা কথা বলে যাচ্ছেন তিনি যা আবেগ এবং কল্পনাপ্রসূত। এদের চিন্তার স্তর জলের ভাসমান শেওলার মতো হালকা ও নির্বুদ্ধিতায় ভরপুর।

এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত মিজানুর রহমান আযহারী কি বললেন।

করোনায় যখন মোদির বাংলাদেশ সফর বাতিল করলো তখন বললেন "করোনা আল্লাহর সৈনিক"।

করোনা যখন মক্কা মদিনার হজ্বসহ পৃথিবীর অনেক দেশের মসজিদ বন্ধ করলো তখন বললেন—

"তিন কারণে আল্লাহ করোনা গজব দিয়েছেন"।

(ভাব খানা এমন যেনো, আল্লাহ তার কানে কানে বলে দিয়েছেন, আমি তিন কারণে গজব দিয়েছি)

করোনা যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করলো তখন বললেন—"করোনায় মরলে শহীদ, বেশি বেশি মসজিদে যান আল্লাহর কাছে কান্না কাটি করেন"।

করোনা যখন তাকে আশ্রয়দাতা দেশ মালয়েশিয়ায় ঢুকলো তখন বললেন—

"করোনা মহামারি, সকলেই সতর্ক থাকুন" (এখানে আল্লাহর সৈনিক উধাও হয়ে গেলো)।

করোনা যখন মালয়েশিয়া লকডাউন করে দিলো,তখন বললেন — "আমি কোথাও বের হই না, ঘরেই নামাজ পড়ি আপনারাও ঘরে নামাজ পড়ুন"।

(নিজের ঘাড়ে আসার সাথে সাথে শহীদ হওয়ার খায়েশ মিটে গেলো)। এ হচ্ছে এসব আলেমদের চরিত্র। এরা মোল্লাতন্ত্রকে ত্যাগ করতে পারে না। আবেগে বা মনগড়া কথা ইসলাম নয়। মনগড়া কথা যে বা যারাই বলবে সেগুলোর দায়িত্ব সম্পূর্ণ তাদের। ইসলাম মানে এরা নয়। ইসলাম খুব আধুনিক ধর্ম। আপনিও একজন ইসলামের সৈনিক হিসেবে ঘরেই নামাজ পড়বেন। আর যদি একজন লোকও আপনার দ্বারা আক্রান্ত হয় তবে আপনি ইসলামের ক্ষতি করলেন। ইসলামের ক্ষতি মানে মানবতার ক্ষতি। হাদিস কোরআন মেনে চলুন। ঘরেই নামাজ পড়ুন।

শফিক সেলিম

মেইল: selimshafiq@gmail.com

লেখক: কবি ও সম্পাদক

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন





ব্রেকিং নিউজ