লকডাউন’ কীভাবে রোগ ছড়ানো বন্ধ করবে?


নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানো প্রতিহত করার জন্য পৃথিবীর প্রায় সব দেশ কোনো না কোনো পর্যায়ের বিচ্ছিন্নকরণ পদক্ষেপ নিয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় আমরা অনেকগুলো নতুন শব্দের সাথে পরিচিত হয়েছি। যেমন- ‘কোয়ারেন্টাইন’, ‘লকডাউন’ ইত্যাদি। যখন কোনো ব্যক্তি কোনো সংক্রমণের শিকার হন; তখন তাকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখার যে ব্যবস্থা তাকেই বলা হয় কোয়ারেন্টাইন, বাংলায় ‘সঙ্গরোধ’। এ রকম অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তি সম্পূর্ণ আলাদা থাকবেন, তার সাথে যোগাযোগ হবে বিশেষ ব্যবস্থায়। ব্যক্তি পর্যায়ে আমরা এ ব্যবস্থা কার্যকর করতে পারি এবং প্রয়োজনবোধে কখনো কখনো একটি পুরো এলাকাকেই এ রকম ব্যবস্থার আওতায় আনা প্রয়োজন হতে পারে। সেই সময়ের জন্য আমরা সাধারণত ‘লকডাউন’ কথাটি বেশি ব্যবহার করি। ‘লকডাউন’ বৃহৎ পরিসরে কোনো এলাকায় কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োগ করা হয়।

এখন প্রশ্ন উঠবে, এই যে বিচ্ছিন্নকরণ ব্যবস্থা তার যুক্তি কী? আদৌ কী এতে কোনো লাভ হবে? কীভাবে?

এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য সংক্রামক ব্যাধির ধরন সম্বন্ধে একটা সাধারণ ধারণা নেওয়া যাক। সংক্রামক ব্যাধি হচ্ছে সেই সব রোগ যা আমাদের শরীরে কোনো জীবাণু যেমন- ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক ইত্যাদির আক্রমণের কারণে হয়। সংক্রামক ব্যাধির মধ্যে কিছু কিছু হতে পারে ছোঁয়াচে রোগ। যেসব রোগ একজন থেকে আরেকজনের স্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়। তার মানে যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রমণের শিকার হন এবং তারপর তিনি কারো সংস্পর্শে আসেন, তাহলে ওই নতুন ব্যক্তির মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে যেতে পারে। পৃথিবীতে অনেক রকমের ছোঁয়াচে রোগ আছে। একটা পরিচিত উদাহরণ চিকেন পক্স বা জলবসন্ত, যা আক্রান্ত ব্যক্তির ছোঁয়া থেকে ছড়িয়ে যেতে পারে; স্ক্যাবিস বা ‘পাঁচড়া’ও এমন ধরনের ছোঁয়াচে রোগ। নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে হওয়া কভিড-১৯ও প্রচণ্ড ছোঁয়াচে একটি রোগ।

যেসব রোগ ছোঁয়াচে (এবং সংক্রামক), তাদেরকে প্রতিহত করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে না আসা। যিনি আক্রান্ত হয়েছেন তিনি হয় ওষুধ সেবন করে বা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে এক সময় সেরে উঠবেন। তারপর আবার তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন। এই যে সময়টুকু আলাদা থাকবেন, সেটাই হচ্ছে তার কোয়ারেন্টাইন পিরিয়ড।

সম্প্রতি যে নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে, তার প্রকাশ হতে প্রায় দুই সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। কেউ যদি আক্রান্ত হন, তাহলে তার ভেতর লক্ষণ প্রকাশের পরে আরও কয়েক সপ্তাহ তাকে সময় দিতে হবে। যাতে তার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। এ সময় শেষে তিনি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন।

ভাইরাস যখন কাউকে আক্রমণ করে; তখন আমাদের শরীর ওই ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য রোগ প্রতিরোধের সাথে যুক্ত বিভিন্ন কোষকে কাজে লাগায়। এসব কোষ ভাইরাসের বৃদ্ধি থামিয়ে দিতে পারে বা তাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। অন্যদিকে ভাইরাস নিজেও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়। এ পরিবর্তনের মাধ্যমে ভাইরাস চায়, যেন সে রোগ প্রতিরোধের কাজে নিয়োজিত কোষগুলোকে ফাঁকি দিতে পারে কিংবা তাদেরকে পরাস্ত (বা ধ্বংস) করতে পারে।

আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত কোষ এবং ভাইরাসের মধ্যকার এই ইঁদুর-বেড়াল খেলায় যদি আমরা জিতে যাই, তার অর্থ দাড়ায়- ভাইরাসটি আসলে নিজেকে বিভিন্নভাবে পরিবর্তন করেও আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে পেড়ে ওঠেনি। সে শেষ পর্যন্ত হয় ধ্বংস হয়ে গেছে অথবা এমন একটা রূপে উপনীত হয়েছে, যেখানে তার রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা আর অবশিষ্ট নেই।

ঠিক এ লক্ষ্যটাই আমরা ‘লকডাউন’র মাধ্যমে অর্জন করতে চাই। চীনের উহান শহরে যখন শুরুর দিকে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছিল এবং অনেক প্রাণহানি হচ্ছিল; তখন চীন সরকার সম্পূর্ণ ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে। এর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে ভাইরাস নির্দিষ্ট জায়গায় বন্দী হয়ে পড়ে। যারা বেশি অসুস্থ ছিলেন তারা চিকিৎসায় ভালো হন, আর যাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী ছিলো তারা নিজেরাই ভাইরাসকে পরাস্ত করেন। প্রায় পঞ্চাশ দিন ধরে ভাইরাসটি উহানের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিজেকে পরিবর্তন করতে করতে শেষ পর্যন্ত অনেকটা অ-ক্ষতিকর অবস্থায় উপনীত হয়।

লেখার সাথে প্রদত্ত ছবিটিতে খেয়াল করলে দেখবেন শুরুর দিকে ভাইরাসগুলো এক রকম ছিল; তখন তারা বেশি মানুষকে আক্রান্ত করছিল, মেরে ফেলছিল। এসব ভাইরাস ছবির নিচের দিকে একসাথে একটা দল পাকিয়ে আছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তাদের ভেতরে পরিবর্তন আসছে। ফলে ছবির উপরের দিকে কিছু ভাইরাস ডানে সরে যাচ্ছে। এরা তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিকর। ‘লকডাউন’র মাধ্যমে কেবল আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমেই এ পরিবর্তন অর্জন করা যায়। আর যদি লকডাউন না করা হতো, তাহলে ওই পরিবর্তিত অবস্থায় যেতে যেতে ভাইরাসগুলো আরও অনেক নতুন মানুষে ছড়িয়ে যেত এবং তাদেরকে সংক্রমিত করে জীবনহানি ঘটাতো।

সুতরাং টেস্ট হোক না হোক, ধরে নিন আপনি আক্রান্ত। এবার নিজেকে যথাসম্ভব বিচ্ছিন্ন রাখুন। এর ফলে আপনিও কারো থেকে ভাইরাসটি পাবেন না, কাউকে আপনি সংক্রমিতও করবেন না। তাহলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভাইরাসটি এমনিতেই যার ভেতরে ছিল, তার ভেতরেই নিস্তেজ হয়ে আসবে। সংক্রামক ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করার এটি একটি অব্যর্থ ব্যবস্থাপনা।

আমাদের দেশের সামর্থ সীমিত। এখানে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ‘লকডাউন’ই হচ্ছে সংক্রমণ ঠেকানোর সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। সুতরাং আসুন সরকারের ‘লকডাউন’ নির্দেশনা মেনে চলি, প্রশাসনকে সহযোগিতা করি। একই সাথে যার যার জায়গা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার বা ব্যক্তিকে সহযোগিতা করে মানবিকভাবে এ সঙ্কট উত্তরণে সচেষ্ট হই।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রজন্মনিউজ২৪/নুর