মধ্যপ্রাচ্যের থমথমে পরিস্থিতি : বাংলাদেশের জন্য যেসব শঙ্কা

প্রকাশিত: ০৫ জানুয়ারী, ২০২০ ০৪:১৫:০৬ || পরিবর্তিত: ০৫ জানুয়ারী, ২০২০ ০৪:১৫:০৬

মধ্যপ্রাচ্যের থমথমে পরিস্থিতি : বাংলাদেশের জন্য যেসব শঙ্কা

ইরাকের রাজধানী বাগদাদে মার্কিন হামলায় ইরানের কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি জটিল রূপ ধারণ করেছে। এ অঞ্চলের তেলসমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলোকে ঘিরে বিশ্ব রাজনীতিতে এমনিতেই বিভাজন ছিলো। পরস্পরবিরোধী দুটি বলয় দীর্ঘদিন ধরে এখানে সক্রিয়। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইলপন্থী বলয়ে রয়েছে সুন্নি মুসলিম অধ্যুষিত সৌদি আরব। অপরদিকে পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষার বিপরীতে সাম্প্রতিক সময়ে এ অঞ্চলের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরান। যে বলয়ে এখন ইরাক-সিরিয়ার মতো দেশ। এদের পেছনে আবার চীন-রাশিয়ার মতো দেশের মদদ রয়েছে।

এই বলয়ের হয়ে মাঠপর্যায়ে সবচেয়ে বেশি তৎপর রয়েছে ইরান। দেশটির হয়ে যেখানে নেতৃইত্ব দিচ্ছিলেন জেনারেল কাসেম সোলেইমানি। ইরাক থেকে সিরিয়া, ইয়েমেন থেকে আফগানিস্তান, লেবানন থেকে ফিলিস্তিনের গাজা পর্যন্ত ইরানপন্থী বলয়ের যে প্রভাব সাম্প্রতিক সময়ে বিস্তৃত হয়েছে, তার পেছনে রয়েছে এই জেনারেলের অভূতপূর্ব অবদান। ইরানের বিপ্লবী প্রতিরক্ষা বাহিনী আল কুদসের প্রধান এ জেনারেলকে গত ৩ জানুয়ারি, শুক্রবার সকালে বাগদাদে হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর মাধ্যমে ৪০ বছর ধরে দেশ দুটির মধ্যে চলা সংঘাতময় সম্পর্কের আগুনে যেন নতুন বারুদ ঢেলে দেওয়া হয়েছে।

আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি-হাসান রুহানির ইরানও যে এর বিরুদ্ধে কড়া প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেবে, তেমনই ইঙ্গিত মিলছে। সর্বোচ্চ শক্তি নিয়েই এর প্রতিক্রিয়া দেখাবে দেশটি। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এক ধরনের চাপা অস্থিরতা-অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে এমন যুদ্ধোন্মুখ পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়েই জ্বালানি তেলের দাম ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ফলে এ নিয়ে বাংলাদেশের চিন্তার কারণ থাকা স্বাভাবিক। তবে এর চেয়েও বড় ভাবনার বিষয়, রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রভাব ফেলতে পারে বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি। তাহলে বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে, কারণ দেশের অর্থনীতির একটি বড় ভিত গড়ে ওঠেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রায় ৮০ লাখ বাংলাদেশির পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ভিত্তি করেই। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই সর্বাধিক সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী কাজ করেন। ওই অঞ্চলে সর্বাত্মক যুদ্ধ-সংঘাত দেখা দিলে বিপুলসংখ্যক প্রবাসীকে দেশে ফিরে আসতে হবে।

এক সৌদি আরবেই বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ বাংলাদেশি নাগরিক কর্মরত আছেন। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, ইরাক, বাহরাইনসহ বাকি দেশগুলোও লাখো প্রবাসী বাংলাদেশির কর্মস্থল। তারা দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হলে আমাদের অর্থনীতিতে তা বড় আঘাত হানবে। উদ্বেগজনক হারে বাড়বে বেকারত্ব। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান উত্তেজনা নিরসনে কার্যকর ও দৃঢ় ভূমিকা রাখার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানানো উচিত বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিষয়ক বিশ্লেষকরা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘কাসেম সোলেইমানি ইরানের জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। পশ্চিমারা মনে করে, একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সমরবিদও ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুতে মধ্যপ্রাচ্যে যে অশান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেটি আরও অশান্ত হবে।’

ইরান হয়তো এ মুহূর্তে কোনো প্রতিশোধ নেবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কিন্তু আগামী বেশ কিছু বছর এ ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত থাকবে। ইরান হয়তো পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিতে পারে।’ এ বিশ্লেষক জানান, মধ্যপ্রাচ্যে তেলের মূল কেন্দ্র হরমুজ প্রণালি। এ ঘটনায় তেলের দামের ওপরও প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যেই তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আর মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এই উত্তেজনা বাংলাদেশের জন্যও চিন্তার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কারণ সৌদি আরব ও ইরাকে আমাদের প্রচুর শ্রমিক আছে। স্বাভাবিকভাবে পরিবেশ অশান্ত হয়ে উঠলে তারা দেশে ফিরে আসবে। বাংলাদেশের উচিত হবে এ ঘটনায় কোনো পক্ষে না গিয়ে নিরপেক্ষ থাকা।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান বলেন, ‘কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার ঘটনায় অনেকগুলো ডাইমেনশন আছে। এ ঘটনার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে আরেক ফ্রন্ট ওপেন করল যুক্তরাষ্ট্র। এতে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।’ জাতিসংঘ যদি এ উত্তেজনা নিরসনে ব্যর্থ হয়, তা হলে সামনে যুদ্ধের মতো ভয়াবহ ঘটনার আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি জানান, বিশ্ব অর্থনীতিতে তা প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশেরও এই উত্তেজনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। তেলের দাম বাড়লে বাংলাদেশে আমদানি ব্যয় বাড়বে।

তিনি আরো বলেন, ‘এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে যে প্রচুর বাংলাদেশি আছেন প্রভাব পড়বে তাদের ওপরও। বাংলাদেশ যুদ্ধ চায় না, শান্তি চায়। তা ছাড়া কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না বাংলাদেশ।’ তাই উত্তেজনা প্রশমনেই বাংলাদেশের কাজ করা উচিত উচিত বলেও মত দেন তিনি। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) আবদুর রশীদ বলেন, ‘কোন একটি স্বাধীন দেশের সরকারি চাকরিজীবীকে অন্য দেশের মাটিতে হত্যার যৌক্তিকতা কতটুকু। এ হামলার ন্যায্যতা বিশ্ব শান্তির পরিপন্থী। মধ্যপ্রাচ্যে এ ঘটনা যুদ্ধাবস্থা তৈরি করেছে। অবশ্য সংঘাতের বিস্তার কতটুকু হবে সেটি ইরানের পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করছে।’

যুদ্ধ না বাঁধার আশা প্রকাশ করেন তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো মধ্যপ্রাচ্যের তেলনির্ভর দেশগুলো এ উত্তেজনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তেলের মূল্য বাড়লে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। তা ছাড়া পুরো মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা থাকলে সেখানকার বাংলাদেশি শ্রমিকরা নিরাপত্তাহীনতার কারণে ফিরে আসতে চাইবেন। এতে রেমিট্যান্সে প্রভাব পড়বে।’ সে-জন্য বিশ্ব শান্তির পক্ষেই বাংলাদেশের অবস্থান থাকা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

প্রজন্মনিউজ২৪/জাহিদ

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ