অসিয়তের বিধান


ক্ষণস্থায়ী এ পৃথিবীতে মানুষের আগমন কিছুকালের জন্য। মৃত্যুই তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। প্রায়ই মানুষ কারো না কারো মৃত্যুর ঘটনা প্রত্যক্ষ করছে। তা সত্ত্বেও সে তার ওপর ন্যস্ত বাধ্যতামূলক ও ঐচ্ছিক দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে উদাসীন থাকে। কিন্তু যখন মৃত্যুর অপ্রতিরোধ্য থাবা তাকে কাবু করে ফেলে, তখন সে অন্তিম মুহূর্তে অস্থির অবস্থায় অনুসন্ধান করে সারা জীবনের দায়িত্ব অবহেলার ক্ষতিপূরণ আদায় করার কোনো উপায় আছে কি না। ইসলামী আইনে সেই মুহূর্তে ক্ষতিপূরণ করার একটি মাত্র পথ আছে, তা হলো অসিয়ত। অসিয়তের মাধ্যমে বিত্তশালী জীবনের অন্তিম মুহূর্তে যেমন গরিবের উপকার করতে পারে, তেমনি অনেক সময় এর মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় সামাজিক কাজও সম্পন্ন করা যায়।

অসিয়ত আরবি শব্দ। যার অর্থ- উপদেশ, পরামর্শ, সুপারিশ, আদেশ, উইল। ÔA Dictionary of Modern Written Arabic’ এ অসিয়তের অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে- Direction, Instruction, Disposition, Injunction, Order, Will, Request. সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষে অসিয়তের অর্থ করা হয়েছে- ভার অর্পণ, নির্দেশ। পরিভাষা শব্দ হিসেবে শেষ ইচ্ছা, ইচ্ছাপত্র বা ইচ্ছাপত্রযোগে প্রদত্ত সম্পত্তি। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’ গ্রন্থে রয়েছে- অসিয়ত শব্দের অর্থ উপদেশ, মিলানো। অর্থাৎ কোনো জিনিস অন্যদের পর্যন্ত পৌঁছানো। ‘ফাতাওয়া ও মাসাইল’ গ্রন্থে রয়েছে, অসিয়ত শব্দের অর্থ কোনো কাজের অঙ্গীকার গ্রহণ করা, নির্দেশ প্রদান করা।

ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় অসিয়ত বলা হয়, ‘কাউকে বিনিময়বিহীন কোনো কিছুর মালিক বানানো, যা অসিয়তকারী ব্যক্তির মৃত্যুর পর কার্যকর হবে। ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’ গ্রন্থে বলা হয়েছে- কোনো ব্যক্তি তার সম্পত্তি বা এর আয় তার মৃত্যুর পর থেকে চিরকালের জন্য অথবা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কোনোরূপ বিনিময় ছাড়াই হস্তান্তর করাকে অসিয়ত বলে। ‘ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’ গ্রন্থে রয়েছে- কোনো বস্তু কিংবা তার মুনাফা সম্পর্কে বলে দেয়া অথবা লিখে দেয়া যে, আমার মৃত্যুর পর এটা অমুকের হবে। ইসলামী অনুশাসনে এরূপ অনুরোধকে অসিয়ত বলা হয়। অসিয়তকারীকে ফিকহ শাস্ত্রের পরিভাষায় ‘মূসি’ অসিয়তকৃত বস্তুকে ‘মুসা বিহি’ এবং যার অনুকূলে অসিয়ত করা হয় তাকে ‘মুসা লাহু’ এবং অসিয়তকারী অসিয়তকৃত সম্পত্তি পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি হিসেবে যাকে নিযুক্ত করে তাকে ‘ওসি’ বলে। ইসলামী শরিয়তে কার্যকর করার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে।

অসিয়তকারী ব্যক্তি বিনিময়বিহীন দান করার অধিকারী হতে হবে। সুতরাং শিশু বা উন্মাদের অসিয়ত কার্যকর হবে না। শিশু বা উন্মাদের অসিয়ত কার্যকর না হওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি এই যে, অসিয়ত হচ্ছে স্বেচ্ছাদান আর শিশু স্বেচ্ছাদানের উপযুক্ত নয়। তা ছাড়া শিশুর বক্তব্য অবশ্য সাব্যস্তকারী নয়। অথবা তার অসিয়তের সিদ্ধান্ত দানের অর্থ হলো তার বক্তব্যকে অবশ্য সাব্যস্তকারী বলে সিদ্ধান্ত দেয়া।

যেহেতু মানুষের মৃত্যুর পর অসিয়ত কার্যকর করার আগে ঋণ পরিশোধ করতে হয়, এ জন্য অসিয়তকৃত বস্তু ঋণগ্রস্ত সম্পদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। কেননা দু’টি প্রয়োজনের মধ্যে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে ঋণের বিষয়টি অসিয়তের চেয়ে অগ্রবর্তী হবে। ঋণ পরিশোধ করা হলো ফরজ আর অসিয়ত হলো স্বেচ্ছাদান। আর সব সময় পর্যায়ক্রমে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দিয়েই কাজ শুরু করা হয়। কাজেই ঋণগ্রস্ত সম্পদের অসিয়ত সিদ্ধ নয়। যার জন্য অসিয়ত করা হবে, সে অসিয়তের সময় জীবিত থাকতে হবে। চাই সে প্রকৃতপক্ষে জীবিত হোক অথবা জীবিতের হুকুমে হোক। এ ক্ষেত্রে অসিয়তের সময় মাতৃগর্ভে সন্তানের অস্তিত্ব প্রতীয়মান হতে হবে এবং অসিয়ত সম্পাদনের ছয় মাসের মধ্যে ভূমিষ্ঠ হতে হবে। এই সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তার অনুকূলে কৃত অসিয়ত কার্যকর হবে না।

যার জন্য অসিয়ত করা হবে, অসিয়তকারীর মৃত্যুর সময় সে তার ওয়ারিশ হতে পারবে না। অবশ্য এ শর্তটি তখনই প্রযোজ্য হবে, যখন অসিয়তকারীর অন্য কোনো ওয়ারিশ বিদ্যমান থাকে। অন্য কোনো ওয়ারিশ না থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ওয়ারিশ হলেও তার জন্য অসিয়ত করা যাবে। রাসূলুল্লাহ সা: বিদায় হজের ভাষণে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেকের অধিকার যথাযথভাবে বর্ণনা করেছেন, সুতরাং ওয়ারিশদের জন্য কোনো অসিয়ত নেই।’ ওয়ারিশ বিশেষের অনুকূলে অসিয়ত করা হলে অপরাপর ওয়ারিশের স্বার্থহানি ঘটতে পারে। এর ফলে তাদের মধ্যে বিভেদ ও সম্পর্কচ্ছেদ ঘটবে। অথচ উভয়টিই হারাম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ফিতনা হত্যা অপেক্ষা গুরুতর অন্যায়।’

এ ছাড়াও রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘কোনো একজন নারী বা পুরুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ৬০ বছর আমল করল। অতঃপর যখন মৃত্যু উপস্থিত হলো তখন তারা অসিয়তের ক্ষেত্রে অন্যের অনিষ্ট করল। তাহলে উভয়ের জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে যাবে। হাদিসটির সনদ জইফ তবে অন্যান্য ওয়ারিশ যদি অনুমোদন করে তাহলে অসিয়ত করা যাবে। এই নিষেধাজ্ঞা ছিল তাদের অধিকারের কারণে। সুতরাং তাদের অনুমোদন প্রদানের কারণে তা জায়েজ হবে। অসিয়তকারীর মৃত্যুর পর অসিয়তকৃত বস্তুটি অন্যের মালিকানায় দেয়ার উপযুক্ত হতে হবে।

চাই তা কোনো সম্পদ হোক অথবা সম্পদ থেকে উপকৃত হওয়া যায় এমন কোনো কিছু হোক তা তৎকালে বিদ্যমান থাকুক বা না থাকুক। মুসা বিহি বা অসিয়তকৃত সম্পদ অবশ্যই মূল্যবান সম্পন্ন জিনিস হতে হবে। যেমন কোনো মুসলমানের জন্য মদ, শূকর ইত্যাদি মূল্যবান জিনিস নয়। সুতরাং এগুলোর অসিয়ত বৈধ নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যা উপার্জন করো এবং আমি যা ভূমি থেকে তোমাদের জন্য উৎপাদন করে দেই, তন্মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় করো এবং এর নিকৃষ্ট বস্তু ব্যয় করার সঙ্কল্প করো না।

কোনো মুসলিম ব্যক্তি অমুসলিম ব্যক্তির অনুকূলে এবং কোনো অমুসলিম ব্যক্তি মুসলিম ব্যক্তির অনুকূলে অসিয়ত করতে পারে। প্রথমটির ব্যাপারে আল কুরআনে এসেছে, ‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করেনি, তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না, আল্লাহ তো ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।’ আর দ্বিতীয়টি যুক্তি এই যে, জিম্মাচুক্তির মাধ্যমে মুআমালাতের লেনদেনের ক্ষেত্রে তারা মুসলিমদের সমান হয়ে পড়েছে। এ কারণেই জীবদ্দশায় উভয়পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাদান বৈধ রয়েছে। সুতরাং মৃত্যুর পরও তাই হবে।

যদি কোনো ব্যক্তি একাধিক অসিয়ত করে তাহলে দেখতে হবে, অসিয়তগুলোর সমষ্টি এক-তৃতীয়াংশ হয়, তাহলে তা অসিয়তকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে। তবে কোনো অবস্থাতেই এক-তৃতীয়াংশের বেশি সম্পদের অসিয়ত করা যাবে না। হাদিসে এসেছে- ‘এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে জানতে চাইল, আমি কি আমার পুরো সম্পত্তি অসিয়ত করতে পারব? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘না’। তারপর আবার বলল, অর্ধেক সম্পত্তি অসিয়ত করতে পারব? রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘না’। তারপর আবার বলল, আমি কি এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি অসিয়ত করতে পারব? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘হ্যাঁ। এক-তৃতীয়াংশই অনেক।

‘ওয়াকফ সংক্রান্ত মাসয়ালা-মাসায়েল’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, কেউ যদি অপর কোনো ব্যক্তিকে বলে, তুমি আমার মৃত্যুর পর আমার উকিল, তখন সে ব্যক্তি তার ওসি হয়ে যাবে। আর যদি বলে, তুমি আমার জীবদ্দশায় আমার ওসি, তবে সে উকিল পরিগণিত হবে। আর যদি বলে, তুমি ১০০ টাকা মজুরি হিসেবে পাবে এই শর্তে যে, তুমি আমার ওসি হবে। তবে শর্ত বাতিল হবে এবং অসিয়ত স্বরূপ সে ১০০ টাকা পেতে পারে এবং নির্ভরযোগ্য মত অনুসারে সে ওসি হবে। কেউ যদি লোকজনকে ডেকে বলে তোমরা সাক্ষী থাকো যে, ‘আমি অমুকের জন্য এক হাজার টাকা অসিয়ত করছি’, তাহলে তা অসিয়ত হিসেবে পরিগণিত হবে। আর যদি বলে- ‘আমি অসিয়ত করছি, অমুকের জন্য আমার সম্পদে এক হাজার টাকা রয়েছে’, তাহলে এ টাকা অসিয়ত নয় বরং স্বীকারোক্তি হিসেবে পরিগণিত হবে।

কেউ যদি অসিয়ত স্বরূপ বলে- ‘আমার বাড়ির এক-তৃতীয়াংশ অমুকের, আমি তা অনুমোদন করছি’, তবে তা অসিয়ত হবে। আর যদি বলে- ‘অমুক ব্যক্তির জন্য আমার বাড়ির মাঝে এক-ষষ্ঠাংশ রয়েছে’, তবে তা স্বীকারোক্তি হবে। অনুরূপ যদি অসিয়তের কথা উল্লেখ করে বলে- ‘অমুক ব্যক্তি আমার সম্পদ থেকে এক হাজার টাকা পাবে’, তবে তা অসিয়ত হবে। কিন্তু যদি বলে- ‘আমার সম্পদে অমুক ব্যক্তির এক হাজার টাকা রয়েছে’, তবে তা স্বীকারোক্তি হবে।

আবার কেউ যদি বলে- ‘আমার এই বাড়িটি অমুকের’, এ ক্ষেত্রে যদি অসিয়তজ্ঞাপক কথার উল্লেখ না থাকে এবং আমার মৃত্যুর পর এ কথা না বলে, তবে তা দান হিসেবে ধর্তব্য হবে। যদি এ দানকারী ব্যক্তির জীবদ্দশায় ওই ব্যক্তি তা দখল করে নেয়, তবে তা সহিহ হবে। কিন্তু দানকারী ব্যক্তির ওফাতের পর দানের এ কথা বাতিল হয়ে যাবে। কোনো অসুস্থ ব্যক্তি যদি অপরকে বলে ‘তুমি আমার ঋণ পরিশোধ করো’, তবে সে ব্যক্তি ওসি হবে। যদি কেউ সুস্থ অথবা অসুস্থ অবস্থায় বলে, ‘যদি আমার কোনো কিছু হয় তবে অমুক ব্যক্তি এত পাবে’, তাহলে তা অসিয়ত হিসেবে ধর্তব্য হবে।

অসিয়ত পুণ্যলাভের একটি উপায়। ইসলামে অসিয়ত কেবল বৈধই নয়, বরং এটি একটি প্রশংসনীয় কাজ। ইসলামের প্রাথমিক যুগে অসিয়ত একটি অত্যাবশ্যকীয় ইবাদত ছিল। অসিয়ত এমন একটি কাজ, যা দ্বারা নিজের প্রিয় সঞ্চয়কে নিজের পছন্দনীয় কাজে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করা যায়। মানুষকে যেহেতু মৃত্যুর স্বাদ অবশ্যই আস্বাদন করতে হবে, সেহেতু তাকে মৃত্যুর সময় এমন কিছু কাজ করে যাওয়া উচিত, যার দ্বারা সমাজের মানুষ উপকৃত হয় এবং পরকালে কঠিন বিপদের মুহূর্তে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে যা মুক্তির উসিলা হিসেবে বিবেচিত হয়। সমাজের বিত্তশালীদের পরকালীন মুক্তির ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে অসিয়ত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।

প্রজন্মনিউজ২৪/জাহিদ