ভয়ঙ্কর তারুণ্য


সন্ধ্যা নামলেই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর দনিয়া বর্ণমালা স্কুল রোডের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক নেমে আসে। বিকাল থেকেই অনামিকা টাওয়ারের ফাস্টফুডের দোকানের সামনে শত শত মোটরসাইকেল নিয়ে হাজির হয় একাধিক কিশোর গ্যাং।

ফুটপাত ও অলিগলিতে তারা অবস্থান নিয়ে নানা অঙ্গভঙ্গি ও ইভটিজিংয়ে মত্ত থাকে। তাদের ভিড়ে সাধারণ পথচারিরাও চলতে পারে না। কোনো কোনো গ্রুপ দনিয়া পোস্ট অফিস গলিতে ঢুকে দলেবলে প্রকাশ্যে মাদক সেবন করে। রাত ৮টার পর তারা চিৎকার, চেঁচামেচি, ধস্তাধস্তি শুরু করে। চলে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত। সন্ধ্যার পর থেকে ওই এলাকার রাস্তা দিয়ে মেয়েরা চলাচল করতে ভয় পায়।

অবিভাবকরা জানান, কিশোর গ্যাংয়ের বেশ কয়েকটি গ্রুপ ফাস্টফুড খাওয়ার নামে প্রতিদিনই অনামিকা টাওয়ার ও এর আশেপাশের দোকানের সামনে আড্ডা জমায়। কখনও কখনও দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারিও বাঁধে। বর্ণমালা স্কুল রোডটির এক পাশে কদমতলী ও অপর পাশে যাত্রাবাড়ী থানার অধীন। এ কারণে দুই থানার পুলিশেরও গাছাড়া ভাব। ভুক্তভোগিরা জানান, চিহ্নিত কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়ে দুই থানাকেই অবহিত করার পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

অথচ পুলিশ মারামারির ঘটনায় বহুবার এখানে এসেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, বেশ কিছুদিন ধরেই এখানে ক্রমেই কিশোর গ্যাংয়ের আড্ডা। দিন যতো যাচ্ছে গ্যাংয়ের সংখ্যা ততোই বাড়ছে। তবে বেশিরভাগ সদস্যই দনিয়া এলাকার বাইরে থেকে আসে। তাদেরকে স্থানীয়রা চেনে না। অচেনাদের মধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার ছেলে অপু আছে। তার সহযোগি ১০/১২ জন। এদের প্রত্যেকের মোটরসাইকেল আছে।

নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন দোকানদার জানান, প্রতিদিন অপু তার সহযোগিদের নিয়ে প্যারিস বার্গারের সামনে অবস্থান নেয়। সন্ধ্যার পর এরা সবাই মিলে চিৎকার চেঁচামেচি, ধস্তাধস্তি করে পুরো এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। আরেকটি গ্রুপ আসে মেয়েদের নিয়ে। তারা ফাস্টফুডের দোকানের সামনে বসে আড্ডা দেয়। নিজেদের সাথে থাকা মেয়েদের সাথে নানা অঙ্গভঙ্গি করে, অশ্লীল কথাবার্তা বলে। যা শুনলে যে কেউ লজ্জা পাবে।

ভুক্তভোগিরা বলেন, সন্ধ্যার পর এই এলাকার পরিবেশ এতোটাই খারাপ হয় যে, প্রয়োজন ছাড়া এখন আর কেউ বাসা থেকে বের হতে চায় না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দনিয়া বর্নমালা স্কুল রোডে অনামিকা টাওয়ারের সামনে প্রতিদিন যে সব গ্রুপ আসে তাদের অধিকাংশ পার্শ্ববর্তি মুরাদপুর, জুরাইন, রায়েরবাগ, শ্যামপুর, ধোলাইপাড়, মীরহাজিরবাগ, পলাশপুর থেকে আসে। বেশিরভাগই মাদকাসক্ত।

মুরাদপুর থেকে আসে মামুন, সৈকত, অভি, মুন্না গ্রুপের বেশ কয়েকজন। এদের সাথে দুজন করে তরুণীও থাকে। একই চিত্র কদমতলী থানার আরও কয়েক স্থানেরও। প্রতিটি এলাকার সাধারণ মানুষ এসব কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ে তটস্ত। গোটা রাজধানীতে ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে এমনি কিশোর গ্যাং। রাজধানীতে এলাকা ভিত্তিক গড়ে উঠছে আলাদা আলাদা কিশোর গ্যাং। কোনো কোনো এলাকায় একাধিক গ্রুপ গড়ে উঠেছে।

এসব গ্যাং ছিনতাই, আধিপত্য বিস্তারে মারামারি, খুনখারাবি, মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন, ইভটিজিং সবই করছে। নিজেদের অবস্থান জানান দিতে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা স্ট্যাটাস দেয়। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমুতে তারা একে অপরের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে। বিপক্ষ গ্রুপকে প্রতিহত করার জন্য প্রকাশ্য হুমকি-ধমকি দেয়া তাদের নিত্যদিনের কাজ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, এরা কথায় কথায় মারামারিতে জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি ভাড়াটে হিসাবেও ব্যবহার হচ্ছে।

এদের বেশিরভাগই মাদকাসক্ত। কেউ কেউ আবার মাদকের ব্যবসার সাথেও জড়িত। প্রভাবশালীরা তাদের ফায়দা হাসিলের জন্য এদেরকে ব্যবহার করে থাকে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র মতে, রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ে কয়েক হাজার কিশোর জড়িত। এদের মধ্যে অনেকেই স্কুলের গন্ডি পার হতে পারেনি। অথচ তারা ভয়ঙ্কর সব অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। র‌্যাব ও পুলিশের অভিযানে গত এক মাসে অন্তত অর্ধশতাধিক কিশোরকে আটক করে কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে।

জানা গেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং উত্তরা এলাকায়। উত্তরায় কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে রয়েছে, পাওয়ার বয়েজ, ডিসকো বয়েজ, বিগ বস, নাইন স্টার ও নাইন এমএম বয়েজ, এনএনএস, এফএইচবি, জিইউ, ক্যাকরা, ডিএইচবি, ব্ল্যাক রোজ, রনো, কেনাইন, ফিফটিন গ্যাং, ডিসকো বয়েজ, পোটলা বাবু, সুজন ফাইটার, আলতাফ জিরো, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার, তুফান, থ্রি গোল গ্যাং। কিশোর গ্যাং এর উৎপাত দ্ব›েদ্ব উত্তরা এলাকার বাসিন্দারা অতিষ্ঠ।

বিশেষ করে বিকালে কোচিং সেন্টারগুলোতে কিশোর গ্যাং সদস্যদের উৎপাতে অবিভাবকরা তটস্ত থাকেন। জসীম উদ্দিন রোডের একজন বাসিন্দা বলেন, আমার মেয়ে বিকালে কোচিংয়ে যায়। অথচ কোচিংয়ের সিড়িতেই ওদের আড্ডা। একইভাবে মার্কেট, বিপনী বিতান, এমনকি জিমগুলোতে এসব কিশোররা প্রকাশ্যে আড্ডা দেয়। ডিএমপির উত্তর বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, আগে যে অবস্থা ছিল, এখন তার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে পুলিশের তৎপরতার কারণে।

সাইবার ক্রাইম বিভাগের অফিসাররা সাইবার পেট্রোলিংয়ের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংদের গতিবিধি নজরদারি করে। উত্তরার পরেই ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং রয়েছে মোহাম্মদপুর এলাকায়। মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের দেয়ালে দেয়ালে লেখা গ্যাংস্টার ‘লাড়া দে’ গ্রুপের লোগো ও স্লোগান। স্থানীয়দের মতে, বছর দুয়েক ধরে এই ‘লাড়া দে’ ও ‘দেখে ল-চিনে ল’, ‹ ‘কোপাইয়া দে’ নামে গ্যাং মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।

তাদের কাছে কার্যত জিম্মি এলাকার মানুষ ও শিক্ষার্থীরা। শুধু ওই গ্রুপই নয়, ঢাকার হাজারীবাগ ও গেন্ডারিয়ায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ‘বাংলা’ ও ‘লাভলেট’ নামে আরও গ্যাং গ্রুপ। শ্যামপুর এলাকায় আছে জাহাঙ্গীর গ্রুপ। বাইক গ্রুপ নামে এরা পরিচিত। দ্বীপ, সবুজ,রিদম, রাজু, খোকন, রিংকু এই গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। কদমতলীর পাটেরবাগ বাগিচায় আছে রাকিব ও তুষার।

এ ছাড়া আলমবাগে জুবায়ের, বাবু, কামরুল, মদিনা মসজিদের গলির সাজু, রেললাইনের আলমগীর, শ্যামপুরে ইমরান, রুমান গ্রুপ এদের গ্যাং এর নাম পেটকাটা গ্রুপ। এদের দলে আছে লিটন, খোকন, আইজি গেইটেরআসলাম, তুলা বাগিচার ইমরান আলী, সাঈদ,সাজ্জাদ। এই সব গ্যাং এর বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মামলা রয়েছে বলে পুলিশ জানায়।

যাএাবাড়ীর মীরহাজীরবাগে আছে অন্তু গ্যাং,পাড় গেন্ডারিয়া এলাকায় সক্রিয় পালোয়ান গ্রুপ, গেন্ডারিয়া থানার নামাপাড়ার বাপ্পি স্কোয়াড, কাঠের পুলের সবুজ গ্যাং, গেন্ডারিয়ার হীরা বাহিনী, নবীন ভাই ভাই গ্রুপ, সুত্রাপুরের কালা ফয়সাল, নারিন্দার বাবু বাহিনী। এরাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরান ঢাকা এলাকায়।

এছাড়া তেজগাঁওয়ে মাঈনুদ্দিন গ্রুপ, মিরপুর-১১ তে বিহারি রাসেল গ্যাং, মিরপুর ১২ তে বিচ্চু বাহিনী, পিচ্চি বাবু ও সাইফুলের গ্যাং, সি ব্লকে সাব্বির গ্যাং, ডি ব্লকে বাবু রাজন গ্যাং, চ ব্লকে রিপন গ্যাং, ধ ব্লকে মোবারক গ্যাং। কাফরুলের ইব্রাহিমপুরে নয়ন গ্যাং, তুরাগে তালাচাবি গ্যাং, ধানমন্ডিতে রয়েছে, নাইন এম এম, একে ৪৭ ও ফাইভ স্টার গ্রুপ, রায়ের বাজারে স্টার বন্ড গ্রুপ ও মোল্লা রাব্বি গ্রুপ, দক্ষিণখানে শাহীন-রিপন গ্যাং, উত্তরখানের বড়বাগে নাজিম উদ্দিন গ্যাং, আটি পাড়ার শান্ত গ্যাং, মেহেদী গ্যাং, খ্রিস্টান পাড়ার সোলেমান গ্যাং, ট্র্যান্সমিটার মোড়ের রাসেল ও উজ্বল গ্যাং, হাজারীবাগে বাংলা ও গেন্ডারিয়ায় লাভলেট, বংশালে জুম্মন গ্যাং, মুগদায় চান-জাদু, ডেভিল কিং ফুল পার্টি, ভলিয়ম টু ও ভান্ডারি গ্যাং, চকবাজারে টিকটক গ্যাং, পোঁটলা সিফাত গ্যাং সক্রিয় রয়েছে।

র‌্যাব জানায়, গত ২৪ আগস্ট রায়েরবাজার ও মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে স্টার বন্ড গ্রুপের ১৭ সদস্যকে আটক করেছে র‌্যাব। পরে তাদেরকে কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে। একই দিন ঢাকার বংশালে জুম্মন গ্রুপের প্রধান জুম্মনসহ ৫ জন কিশোরকে আটক করে র‌্যাব। ২৫ আগস্ট মুগদার মান্ডা এলাকায় অভিযান চালিয়ে চান-জাদু গ্রুপ, ডেভিল কিং ফুল পার্টি, ভলিয়ম টু ও ভান্ডারি গ্রুপের ২৩ সদস্যকে আটক করা হয়।

১০ আগস্ট মিরপুর -১ নম্বর থেকে কিশোর গ্যাংয়ের ২৪ জনকে আটক করে র‌্যাব। ৭ আগস্ট রাতে কাওরান বাজার, ফার্মগেট, কলেজগেট, শিশুমেলা, শ্যামলী ও মোহাম্মদপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৪৬ জনকে আটক করে র‌্যাব-২। তাদের মধ্যে ১১ জনকে রায়েরবাজারে ছিনতাই করার সময় হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে ২৮ জুলাই মোহাম্মদপুরে অভিযান চালিয়ে লাড়া দে ও লেভেল হাই গ্রুপের ২ সদস্যকে আটক করে র‌্যাব।

১৫ জুলাই রাতে তুরাগের বাউনিয়া থেকে নিউ নাইন স্টারের ১১ সদস্যকে আটক করে র‌্যাব-১। ভুক্তভোগিদের মতে, স¤প্রতি বরগুনায় আলোচিত নয়ন বন্ডের ‘০০৭’ গ্রুপের চেয়েও কিশোর গ্যাং সদস্যরাা দুর্ধর্ষ ও ভয়ঙ্কর। স্থানীয় প্রভাবশালী বড় ভাই বা নেতা পেছন থেকে এদেরকে সহায়তা করে বলেই ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস করে না। একই কারণে এসব গ্রুপের কর্মকান্ড সম্পর্কে সব জেনেও এলাকার পুলিশ নির্বিকার।