সমাজে পরিশুদ্ধ জ্ঞানের আলো ফুটলে সাফল্যের সোপান প্রতিষ্ঠিত হবে


শুরুতেই একটা গল্প বলি। ছেলে রেজাল্ট শিট নিয়ে এসে বাবার হাতে দিল। বাবা এক নজরে বিভিন্ন বিষয়ের নাম্বার গুলো দেখে ভীষণ রেগে গেলেন। ছেলের উদ্দেশ্যে বাবা বলেন, তুমি অংকে পাশ করোনি! ইংরেজিতে মাত্র পঁয়তাল্লিশ নাম্বার পেয়েছো।

কোচিং, হোম টিউশনি করার পরও তোমার রেজাল্টের এই অবস্থা। তোমার মাকে ডাকো। মাকে ছেলে ডেকে আনলো, মা এসে বাবাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ছেলেকে আচ্ছামতো ধমক দিলেন। অত:পর বাবা বললেন, আমার কোনো হোম শিক্ষক ছিলোনা, তারপরেও আমি অংকে নব্বইয়ের নিচে কখনো পাইনি আর ইংরেজীতে তো আশি থাকতোই।

এই বলেই বাবা রেজাল্ট শিটটি ফেলে দিলেন। ছেলে ভয়ে ভয়ে বলল,বাবা রেজাল্টটা আমার নয়, তোমার পুরোন কাগজপত্রের মধ্যে ছিল। বাবা হাতে নিয়ে দেখলেন সত্যিইতো। এই হলো আমাদের অবস্থা। আমি যা নই তাই বেশির ভাগ বলি একিছু বলার আগে যে একটু ভাবতে হয় সেই ভাবনাটাও করিনা, কারো ইচ্ছেও নেই।

আমাদের গভীর ভাবনার মাধ্যমেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করা যায়। আর তার জন্য প্রয়োজন নিজেকে সময় দেয়া। নিজেকে যতো বেশি সময় দেয়া যাবে, ততো বেশি নিজেকে এই সমাজের জন্য তৈরি করা যাবে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আমাদের জীবন যাপনের উন্নতি হচ্ছে ঠিকই কিন্তু মননশীল মানুষ তৈরি হচ্ছে কম। আমি যা নই তা প্রচারে ব্যস্ত না হয়ে বরং আমি কি চাই তা পাওয়ার চেষ্টা করাই হচ্ছে মানুষের অন্যতম ব্রত।

আমদের সমাজের কি অবস্থা, কয়েকটি ঘটনা শুনলেই বুঝা যাবে,আমরা যে দ্বৈত এক এনজিও কর্মী সামাজিক ব্যধি যৌতুক বিষয়ে সাপ্তাহিক সেমিনারে বক্তব্য প্রধান করছিল। যৌতুক দেয়া নেয়া যে আইনের চোখে অপরাধ এ সম্পর্কেই উপস্থিত লোকজনকে অবগত করছিল।

সেমিনারে মধ্যখানে এই এনজিও কর্মীর কাছে একটি ফোন আসলো, তার ফোনে কথা বলা শুনে যতোটুকু বুঝা গেল তার বিয়ের দেনা পাওনার কথা হচ্ছিল। বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে শুধু দেনা পাওনাতে আটকে আছে। তার বাবার খরচ হয়েছে তাকে লেখাপড়া শিখাতে কাজেই তাকে উপহার নিতেই হবে। তাকে বলা হলো এটাকেই যৌতুক বলে।

সে স্বীকারও করলো। তার সেমিনারের বিষয়টিও এই সামজিক ব্যাধি দূর করতে। তারপরও সে বলে চাকরির জন্য তাকে বলতে হচ্ছে-ওটা তার পেশা। তার পেশাটা হলো অর্থ উপার্জনের জন্য কিন্তু জীবন চর্চার জন্য নয়। ঠিক এই কাজটি যদি কোনো শিক্ষক করতেন তখন তাকে বলা হতো শিক্ষকতা মহান পেশা।

শিক্ষক হল মানুষ গড়ার কারিগর। এর সেই শিক্ষক যদি আইন না মানে, সমাজ না মানে তার মধ্যে যদি নীতি না থাকে তাহলে ছাত্ররা তার কাছ থেকে ভালো কিছু শিখতে পারে না। সেই শিক্ষক ভালো শিক্ষক হতে পারে না ইত্যাদি । বিষয়টি দাঁড়িয়েছে সুযোগ পেলেই নীতি কথার ছড়াছড়ি নিজে মানি না চর্চা করি না। প্রকৃত অর্থে এই কর্মীও একজন শিক্ষক।

দুইজনে শিক্ষা দান করেছেন। স্বীকৃত পেশার সাথে জীবনের চর্চাও থাকতে হবে। সব কিছু নিজেকে দিয়ে বিচার করতে হবে। সব কিছু বিবেক দিয়ে বিচার করতে হবে। যে শব্দ বা কথা আমার শুনতে ভালো লাগে না, তা আমি অন্যকে বলবো না। যদি আমার কথা বলার ক্ষেত্রে এমনটি মেনে চলতাম তাহলে ব্যক্তিগত জীবনে, পরিবারে, সমাজে, তথা সব জায়গাতে অনেক ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়া যেত।

ক্ষমতায় গেলে বলা হয় হরতাল ভালো নয়, হরতাল করা ঠিক নয়। হরতাল করলে দেশের ক্ষতি হয়।অথচ সেই দল ক্ষমতায় না থাকলে সব ভুলে যায়। তারাও হরতাল করে।

আবার ব্যক্তির ক্ষেত্রে দেখা যায় আমাকে কেউ বেয়াদব বললে আমি মেনে নিতে পারিনা, আবার সুযোগ পেলে আমিই অন্যকে বেয়াদব বলে যাচ্ছি। এই হলো আমাদের চরিত্র। মানুষ এখন কথা দিয়ে কথা রাখে না। অথচ মানুষের আগের চেয়ে সক্ষমতা বেড়েছে। বেড়েছে তার আয়, বেড়েছে শিক্ষা গ্রহণের পরিধি।

কিন্তু তারপরও আমাদের চরিত্রের' উন্নতি হয়নি, আমরা দ্বৈত চরিত্র চর্চা করেই যাচ্ছি। দেখা যায় বেশির ভাগ মানুষ রাজনীতির মূল ভুলে কথা দিয়ে কথা না রাখা এই মন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে গেছে। আর মন্ত্রটি যেন শিক্ষিত, অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত সবাই সহজে গ্রহণ করছে এবং চর্চা করছে। ফলে দ্বৈত চরিত্রের অধিকারী হয়ে যাচ্ছে মানুষ। আর তাইতো মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে চাইছে না।

যে মানুষের মধ্যে দ্বৈত চরিত্রে চর্চা যতো বেশি সেই মানুষেই অন্যের চরিত্র নিয়ে কথা বলে সবচেয়ে বেশি। এর কারণ সে নিজেকে জানে না, নিজেকে চেনে না। আর নিজেকে জানতে হলে, নিজেকে চিনতে হলে সবার আগে প্রযোজন নিজেকে সময় দেয়া। তাহলেই নিজের ভেতরে একটা আলাদা ভুবন তৈরি হবে। যার ভেতর নিজের ভুবন নেই, তার আপন সত্ত্বা নেই।

যার নিজস্বতা নেই তার স্থায়িত্ব নেই। যদিও পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষেরই এই অবস্থা। তারা পৃথিবীতে আসে আরাম আয়েশ করার জন্য। পৃথিবীর কাছে থেকে তার শুধু নিয়েই যায়, কিছু দেওয়ার চেষ্টা করেনা। আর সেতো দিতে চাইলেও দিতে পারবে না।

কারণ সে নিজের ভিতরের ভুবনকে তৈরি করতে পারেনি। আবার কিছু মানুষ উচ্চ শিক্ষিত, তাদের কর্ম আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু তারা নিজের দেশকে পছন্দ করে না, দেশের জন্য সমাজের জন্য কিছু দেওয়ার চেষ্টা করেনা। এই দেশটাই কিন্তু তাদের তৈরি করেছে এ কথা তারা ভুলে গেছে।

যদি আমরা কথা বলার আগে ভেবে নেই যে, তা বলা যাবে কিনা-কোনু প্রতিক্রিয়া হবে কিনা, আমি তা চর্চা করি কিনা তাহলে দ্বৈত নীতির কিংবা দ্বৈত চরিত্রের অধিকারী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। দ্বৈত নীতি যেমন ভালো নয় তেমনি দ্বৈত চরিত্র আরো নিম্নমানের। যাকে বলা হয় স্ববিরোধীতা।

আমাদের এই স্ববিরোধীতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।আর তা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দরকার নিজের ভিতরের ভুবন তৈরি করা। আর ভুবন তৈরি করতে দরকার নিজেকে সময় দিয়ে নিজের যোগ্যতাকে প্রমাণ করা। আর তাতেই সকলের নিকট নিজ যোগ্যতার প্রকাশ ঘটবে। তবেই না মানুষ হিসাবে জন্ম নেয়াটা সার্থক ও সাফল্য মন্ডিত হবে।

শেখ জাহিদ হাসান

লেখকঃ সাংবাদিক ও সাহিত্যকর্মী

প্রজন্মনিউজ২৪/শেখ ফরিদ