নারীর ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে

প্রকাশিত: ১৪ মে, ২০১৬ ০১:০২:০৫

নারীর ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে

বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ফলাফল অর্জনের পাশাপাশি নিয়মিতভাবে প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশে এবং বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন সুদূরপ্রসারী ও টেকসই করতে হলে এই অগ্রযাত্রায় কন্যাশিশু ও নারীদের সমান অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কন্যাশিশু ও নারীদের ক্ষমতায়ন শুধু যে সঠিক কাজ তা নয়, এটি টেকসই উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে কার্যকর বিনিয়োগ, যার প্রভাব নারীদের ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যখন অতিরিক্ত ১০ শতাংশ কন্যাশিশু স্কুলে যায়, তখন একটি দেশের জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। যখন নারীরা তাঁদের কাজের ন্যায্য মজুরি পান, তখন তাঁদের পরিবারের উন্নতি হয়। গবেষণায় দেখা যায়, নারীরা তাঁদের উপার্জনের একটি বড় অংশ সন্তানের স্বাস্থ্য, লেখাপড়া ও পরিবারের উন্নতির কাজে ব্যয় করেন, যেখানে পরিবারের পুরুষেরা প্রায়ই অন্যান্য বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণকে সমর্থন জোগানো এবং সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা শুধু নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের পথ নয়, এর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন ও ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি লাভ করা সম্ভব।
কন্যাশিশু ও নারীরা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। তাঁরা ভোক্তা, চাকরিজীবী ও উদ্যোক্তা হিসেবে বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। কিন্তু খাদ্য উৎপাদন ও অন্যদের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে নারীর যে অবদান, তা অবৈতনিক এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার কোনো স্বীকৃতি নেই। টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে অবদান রাখা সত্ত্বেও কন্যাশিশু ও নারীরা বিশ্বের দরিদ্রতম গোষ্ঠী। পুরুষের তুলনায় তাঁদের আয় অনেকাংশে কম, তাঁরা বেশি সময় কাজ করেন এবং জমি, প্রাকৃতিক সম্পদ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে প্রায়ই বঞ্চিত হন।
ডেনমার্ক ও বাংলাদেশ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে উন্নয়নের সহযোগী। ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও নারী-পুরুষের সমতার গুরুত্বের ক্ষেত্রে এ দুই দেশ একই মূল্যবোধ ধারণ করে। ডেনমার্ক এমন একটি দেশ, যেখানে নারী-পুরুষের সমতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। নারী ও পুরুষকে সমান দৃষ্টিকোণে দেখা এবং ছেলে ও মেয়েদের সমান সুযোগ প্রদান সে দেশের সমাজকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে এবং আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে অনুপ্রাণিত করেছে। গত বছর ডেনমার্ক দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচনে নারীদের ভোটাধিকারের শতবর্ষ পূর্তি উদ্যাপন করেছে, যা সমাজে পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনের জন্য নারীর দীর্ঘ ও কঠোর সংগ্রামের সফল পরিণতি হিসেবে বিবেচ্য। ধীরে ধীরে সমাজে নারীর প্রভাব ও কাজের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭৬ সালে সমান কাজের জন্য সমান বেতন আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং ২০১১ সালে ডেনমার্কে প্রথমবারের মতো একজন নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন।
কিন্তু নারী ও পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার লড়াই এখনো শেষ হয়নি। ডেনমার্ককে এখনো নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। কার্যত নারী ও পুরুষের মধ্যে বেতনবৈষম্য এখনো বিদ্যমান। নারীরা জীবনসঙ্গী দ্বারা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন এবং সমাজে নারী-পুরুষ সম্পর্কে যে গৎবাঁধা ধারণা রয়েছে, তা নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। এ বাধাগুলো মোকাবিলা করার লড়াই চলছে এবং চলবে।
দুই দশক ধরে বাংলাদেশ কন্যাশিশু ও নারীদের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। রাজনৈতিক শীর্ষস্থান থেকে শুরু করে ব্যবসা, সংস্কৃতি ও গণযোগাযোগমাধ্যমে নারীর এখন দৃপ্ত পদচারণ। জাতীয় সংসদে নারী জনপ্রতিনিধির সংখ্যা ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ হয়ে ২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। নারীর স্বাস্থ্যগত উন্নতিও পরিলক্ষিত হয়েছে। নারীর আয়ুষ্কাল ১৯৮০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ৫৪ বছর থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭৩ বছর হয়েছে। মাধ্যমিক স্কুলে মেয়েদের ভর্তির ক্ষেত্রে এসেছে চমকপ্রদ সাফল্য। স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি, অভাবগ্রস্ত মেয়েদের স্কুলমুখী করতে বৃত্তি প্রদান এবং শিক্ষা খাতে চলমান বিনিয়োগ বাংলাদেশে একটি ইতিবাচক বৃত্ত গঠনে সাহায্য করেছে। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ও সুশিক্ষিত নারী শ্রমবাজারের বড় সম্পদ। নারীদের কাজের সুযোগ বৃদ্ধির গুরুত্ব তৈরি পোশাক খাতে বিশেষভাবে স্পষ্ট, যেখানে ৪০ লাখ জনশক্তির ৮০ শতাংশই নারী।
উল্লেখযোগ্য সাফল্য থাকা সত্ত্বেও কিছু বাধা রয়েই যায়। দুর্ভাগ্যবশত নারীরা এখনো সহিংসতা ও হয়রানির শিকার হয়ে চলেছেন। নারীদের সহিংসতার হাত থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ডেনমার্ক এ কার্যক্রমে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে আসছে। এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু কার্যকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে, যাদের কাজ নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা এবং নির্যাতিত নারী ও পরিবারকে সেবা প্রদান করা। ডেনমার্কের সহায়তায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি হেল্প লাইন প্রতিষ্ঠা করেছে, যা সহিংসতার শিকার নারীদের পরামর্শ প্রদান করে, আইনি উপদেশ দিয়ে সহায়তা করে, পুলিশি সাহায্য প্রদান করে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সুপারিশের ব্যবস্থা করে। হেল্প লাইন নম্বরটি হলো ১০৯২১। নম্বরটি এই লেখার পাঠকদের, তাঁদের পরিবার, বন্ধু, সহকর্মীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করার মাধ্যমে সমাজে নারী ও কন্যাশিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে যোগদানের আবেদন জানাই।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যখন অতিরিক্ত ১০ শতাংশ কন্যাশিশু স্কুলে যায়, তখন একটি দেশের জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। যখন নারীরা তাঁদের কাজের ন্যায্য মজুরি পান, তখন তাঁদের পরিবারের উন্নতি হয়

ছয় মাস আগে কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা দারিদ্র্য বিমোচন ও টেকসই উন্নয়নের জন্য ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেন, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস বা এসডিজি) হিসেবে পরিচিত। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য নারী ও কন্যাশিশুর উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহীত উদ্যোগগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যে মেয়েরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, যে বিপুলসংখ্যক নারী পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত, যেসব নারী নিজেদের চাষের জমির মালিক হতে চান এবং অর্থনৈতিক সেবা পেতে চান, এই লক্ষ্যমাত্রা তাঁদের সেই সব স্বপ্ন পূরণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বাংলাদেশের সঙ্গে সঙ্গে ডেনমার্ক, ইউএনএফপিএ এবং ইউএন উইমেন ২০৩০ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার প্রয়াসে স্থিতিশীল সমাজব্যবস্থা গঠনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যেখানে প্রত্যেক নারী নিজেই নিজের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন এবং বৈষম্যমুক্ত ও স্বাধীন জীবনযাপনের সুযোগ পাবেন।
১৬ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠেয় তৃতীয় উইমেন ডেলিভার কনফারেন্সে (ডব্লিউডিসি) রাজনীতিক, নীতিনির্ধারক, চিকিৎসক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গণমাধ্যমের ব্যক্তিরা মিলিত হবেন। কনফারেন্সের আগে ১৫ থেকে ১৬ মে একটি মিডওয়াইফারি সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হবে এবং এই ধারাবাহিকতায় ১৬ মে মন্ত্রী ও সাংসদ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। কোপেনহেগেনে এবার তৃতীয়বারের মতো ডব্লিউডিসি অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। এর আগে ২০০৭ সালে ওয়াশিংটন ডিসি ও ২০১৩ সালে কুয়ালালামপুর এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। এর প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়গুলো হলো স্বাস্থ্য, বিশেষ করে মাতৃত্বকালীন, যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য, অধিকার এবং নারী-পুরুষ সমতা, শিক্ষা, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন। সম্মেলনের প্রধান লক্ষ্য হলো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ কীভাবে অর্জন করা সম্ভব তা আলোচনা করা, যা নারী ও কন্যাশিশুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডেনমার্কে এবারের সম্মেলনটির আয়োজক উইমেন ডেলিভার, ইউএনএফপিএ এবং ইউএন উইমেন।
উইমেন ডেলিভার কনফারেন্স ২০১৬ ব্যাপক পরিসরে বিভিন্ন সহযোগী গোষ্ঠীর মধ্যে ভিন্ন মতাদর্শ ও ভাবের আদান-প্রদান এবং সর্বোত্তম কর্মপন্থা সম্পর্কে আলোচনার অনন্য সুযোগ সৃষ্টি করবে, যাতে করে একে অপরকে সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী নারী ও কন্যাশিশুর কল্যাণ সাধিত হবে। আমাদের আশা, এই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সবাই এই সুযোগটিকে কাজে লাগাবে এবং তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ গঠনে নারী ও কন্যাশিশুর স্বাস্থ্য ও অধিকার সমুন্নত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। নারী ও কন্যাশিশুর উন্নয়ন মানেই সমাজের উন্নয়ন—আমরা বার্তা শুধু বিশ্বনেতাদের মধ্যে নয়, বরং প্রত্যেক নাগরিক, প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ, গবেষণাকেন্দ্রসহ সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে দিতে চাই।
উইমেন ডেলিভার ২০১৬ কনফারেন্সের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, উচ্চপর্যায়ের বক্তা এবং অংশগ্রহণের তথ্যসহ বিস্তারিত জানতে কনফারেন্সের ওয়েবসাইট ভিজিট করুন <http://wd 2016. org/>
হানেফুগল এস্কায়ের: বাংলাদেশে ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত।
আর্জেন্টিনা মাতাভেল পিচ্চিন: বাংলাদেশে ইউএনএফপির প্রতিনিধি।
ক্রিস্টিন হান্টার: বাংলাদেশে ইউএন উইমেনের প্রতিনিধি।

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



A PHP Error was encountered

Severity: Notice

Message: Undefined index: category

Filename: blog/details.php

Line Number: 417

Backtrace:

File: /home/projonmonews24/public_html/application/views/blog/details.php
Line: 417
Function: _error_handler

File: /home/projonmonews24/public_html/application/views/template.php
Line: 199
Function: view

File: /home/projonmonews24/public_html/application/controllers/Article.php
Line: 87
Function: view

File: /home/projonmonews24/public_html/index.php
Line: 315
Function: require_once

বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আরো সংবাদ