সুবোধের ঘুম ভাংতে শুরু করেছে


একটা সময় জেলখানার পাশে দিয়ে যাওয়ার সময় অথবা প্রিজন ভ্যানে করে পুলিশ আসামি নিয়ে যাওয়ার সময় মনে হতো ভেতরে যারা আছে সবাই অপরাধী।এখন যুগ পাল্টে গেছে।অনেক কিছুতেই বৈপরিত্য লক্ষ করা যাচ্ছে।আমাদের ধারনাও পাল্টে দিতে সক্ষম হয়েছে শাসক শ্রেনি।

এখন ইয়াবা বদির ইশারায় মাদক ব্যাবসায়ী ট্যাগ দিয়ে বন্দুকযুদ্ধের নাটক করে হত্যা করা হয় একরামুলকে আর ইয়াবা সম্রাট হিসেবে খ্যাত বদিকে পাঠানো হয় ওমরা পালন করতে।এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরো কত নাটক মঞ্চস্থ হলো ।যদিও নাটকের স্ক্রিপ্ট রাইটারদের কাঁচা হাতে লেখা নাটকের ফাকফোকড় বুঝতে আমাদের কষ্ট হয়নি।

এখন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা তরিকুলকে ছাত্রলীগ কর্তৃক হাতুড়ি দিয়ে পা ভেঙে দেয়ার পর সেই ছাত্রলীগ নেতা ক্যাম্পাসে বুক ফুঁলিয়ে চলে আর তরিকুলের নামে মামলা হয়।

এখন কোর্ট চত্ত্বরে মাহমুদুর রহমানের উপরে পুলিশের উপস্থিতিতে ছাত্রলীগ হামলা করে আর পুলিশ নপুংশের ভূমিকা পালন করে!

এখন প্রধানমন্ত্রীর মতো মানুষ সংসদে প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরে বলেন “আমি পরিস্থিতি ঠিক করার জন্য বলছিলাম”।আসলে আমাদের বিশ্বাস করার মতো কি থাকলো আর!

এখন সড়ক দূর্ঘটনায় ৪ জন স্কুলছাত্র নিহত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় মন্ত্রী দাঁত বের করে বলেন“ভারতে সড়ক দূর্ঘটনায় ৩০ জন মারা গেলেও কোনো হইচই হয় না”।

এসব অনিয়ম দেখে এখন আর জেলখানায় বন্দি সবাইকে অপরধী মনে হয় না!

আমরা এখন অভ্যস্থ হয়ে গেছি;মেনেই নিয়েছি।বিচার বহির্ভুত হত্যা,চাঁদাবাজি,ধর্ষন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।এসব অন্যায়ে জনমনে প্রতিবাদের জোয়ার উঠলেও শাসকশ্রেনি ঘুমে থাকে ;তাদের কিছুই ঠিক থাকেনা।

তবে লক্ষনীয় ব্যপার হলো,এসব অন্যায় নিয়ে জনমনে তীব্রতা বেশি না ছড়ালেও টিএসসির চুম্বন দৃশ্য নিয়ে খুব হতাশ হয়েছিলো!জাত গেলো অবস্থা।দেশে দৈনিক শতশত এ্যাবরশন হচ্ছে,কয়লা চুরি হয়ে যায়,বাংলাদেশ ব্যাংকের সোনা নকল হয়,নুরুর মতো ছাত্রনেতাকে যেভাবে অত্যাচার করা হলো এসবে জাত যায় না।টিএসসির চুম্বন দৃশ্যে জাত যায়।আমাদের সিলেক্টিভ জাত ।অল্পতেই যায় আবার বেশিতেও যায় না।

মানুষের সহোজাত বৈশিষ্ঠ্য কি সেটা জানার জন্য অনেক গবেষনা হয়েছে।মানুষের সহোজাত বৈশিষ্ঠ্য হলো ‘সত্যতা’ অর্থ্যাৎ ভালোগুন।এবং অধিকাংশ মানুষই সৎ অল্প মানুষ অসৎ।তাহলে এই অল্প অসৎ মানুষই বেশি সৎ মানুষের উপর অসত্যের রাজত্ব করে কিভাবে! আমাদের অধিকাংশ মানুষের এমন একটা ধারনা চুপচাপ থাকা,বড়রা অন্যায় করলেও কিছু না বলা-এসব ভদ্র মানুষ চেনার উপায়।এরকম ভদ্র না হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনেক আগেই এসেছে।

তবে এতো নিরাশার মধ্যেও ইতিহাস আমাদের সাহস যোগায়।গোবড়ের মধ্যে যেমন পদ্মফুল ফোটে কখনো কখনো।তেমনি অন্ধকারের মধ্যেও কেউ আলোর মশাল নিয়ে সবাইকে মুক্ত করতে পারেন।যেমনটা আমরা দেখেছি দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া বীর ‘নেলশন ম্যান্ডেলাকে’।

কিউবার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাবের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া ‘ফিদেল কাস্ত্রো’র মতো বীরকে দেখেছিলাম।যিনি বলেছিলেন-আমি বিপ্লব শুরু করেছিলাম ৮০/৮৫ জন নিয়ে কিন্তু আমি এখন কোনো বিপ্লবের ডাক দিলে ১০/১২ জন নিয়ে দেব,কারন আমি সংখ্যায় বিশ্বাস করিনা।

আমরা পেয়েছিলাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে’র মতো,শহিদ মেজর ‘জিয়উর রহমানে’র মতো নেতা।

ওনাদের নামটাই শত হতাশার মাঝেও সাহস ধরে রাখার অনুপ্রেরনা।ওনাদের বিসর্জনেই আজও আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন।ওনারাই সুবোধ,সুনায়ক,সুজন।এই সুবোধ আজো আছে;তারা জাগতে শুরু করেছে।

আমরা কিছু সুবোধ দেখতে শুরু করেছি।কোটা সংস্কার আন্দোলনের নুরুরা ইতিমধ্যেই আমাদের সাহস যুগিয়েছে।সম্প্রতি কুর্মিটোলায় যাত্রী বহনকারি একটি গাড়ি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের উপরে উঠিয়ে দিয়ে হত্যায় সুবোধরা ফেটে পড়েছে।এসব সুবোধদের দেখলে এদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা কিছুটা হলেও হ্রাস পায়।

আমরা যে আমাদের রাষ্ট্রের পরিচালকদের ঘাড়ত্যাড়ামি,তাদের নোংরা রাজনীতি পদদলিত করতে শুরু করেছি-এটাই কম কিসে?আমরা আশাবাদি হই যখন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের শ্লোগান হয় এমন-“যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ,যদি প্রতিবাদি  হও তবে তুমিই বাংলাদেশ”,“আমার ভাইর রক্ত লাল,পুলিশ কোন চ্যাটের বাল”,“ রাজনীতি মেধায় লাথি মারছে”,রাজা আছে নীতি নাই,নেতা চো...টাইম নাই”।

অনেকে ওদের শ্লোগানের ভাষায় অশ্লীলতা খুজে থাকেন!ভাই,জ্বি হুজুর-জ্বি হুজুর শ্লোগান দিয়ে কখনো অধিকার অদায় হয় না।অধিকার আদায়ের সময় কারো শার্টের কলার ধরতে হয়, কারো কানমলে দিতে হয়-এতে বাঁকা চোখে তাঁকানোর কিছু নাই।

কিছুদিন আগেও মানুষ সরকারের অন্যায় নিয়ে রাস্তা ঘাটে কিছু বলতো না।কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রলীগের ভয়ে ওদের অন্যায় নিয়ে সাধারন শিক্ষার্থীরা কিছু বলার সাহসই পেতো  না।নিউজ পেপার,টিভি চ্যানেলগুলো সরকারের চাটুকারীতায় ব্যাস্ত থাকতো।এখন সাধারন মানুষ কথা বলতে শুরু  করেছে।কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রলীগকে যাচ্ছেতাই করতে দেওয়া হচ্ছে না।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ৫৭ ধারায় বুঁড়া আঙুল দেখিয়ে প্রতিবাদ চলছে।দেশের জনগন যে সরকারের অযোগ্যতা,গোয়ার্তুমি,অসত্যতা বুঝে ফেলেছে এবং সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে-তোমাদের প্রকৃত রুপ আমরা চিনতে ভুল করিনি।এটাও ক্ষমতাশালীদের জন্য একটা চপেটাঘাত।মানুষের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে  অনেক কিছুই করতে বাধ্য হয়।

যাই হোক অনেক দেরিতে হলেও আমাদের ঘুম ভাংতে শুরু করেছে।এভাবে একসময় সকলের ঘুম ভেঙ্গে যাক।অনেকেই সুবোধ হতে শুরু করেছে।এদেশের শিক্ষাঙ্গনে ,জাতীয় সংসদ ভবনের মতো যায়গায় অযোগ্য, হিংস্ররা যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াবে আর সুবোধদের বিবেক ঘুমিয়ে থাকবে -এটা হয় না।সুবোধরা ঘুমিয়ে থাকতে পারেনা-জেগে উঠবেই।

  মুজাহিদ গাজী লেখক ও সাংবাদিক