পৃথিবীর স্বর্গ কাশ্মীর


জয়নাল আবেদিন: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লিলাভূমির আর এক নাম কাশ্মির। ভু-স্বর্গ,পৃথিবীর সুন্দরতম স্থান,এশিয়ার সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত প্রকৃতির বিচিত্র এক সৌন্দর্য্যরে আঁধার কাশ্মীর উপত্যাকা। হিমালয় পর্বতমালার তল ঘেষে এই স্থানটি পৃথিবীর সব প্রান্তের ভ্রমণ পিয়াসীদের জন্য এক পরম গন্তব্যস্থল। প্রাকৃতিক পরিবেশ, রাশি রাশি ফুলের মেলা, বরফজল হতে উৎপন্ন নানা নামের নদী ,অনিন্দ্য সুন্দর পাহাড়ী উপত্যাকা, বিভিন্ন হিমবাহ এবং আরো অনেক কিছু কাশ্মীর উপত্যাকাকে যেন এক পরিপূর্ণ ভ্রমণ তীর্থে পরিণত করেছে।

ডাল লেকে বর্ণিল চিনার গাছ

মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর তার স্ত্রী নুরজাহানের জন্য একটি বাগান তৈরি করেন। ৫৩৯ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮২ মিটার প্রস্থের বাগানে আছে ঝর্ণা ধারা, নানা প্রজাতির ফুল আর হরেক রকম ফলের গাছ। এর বিশেষত্ব আছে আরও। শীতকালে বরফ আচ্ছন্ন বাগানটি বসন্তকালে ভরে উঠে ফুলে ফুলে। বাগানে প্রবেশ করতেই স্বাগত জানাবে বিশাল আকৃতির চিনার আর পাইনের দল। নুরজাহানের জন্য তৈরি শালিমার বাগ নামের এ বাগানটির দেখা পাওয়া যাবে প্রাকৃতিক ভূ-স্বর্গ হিসেবে পরিচিত কাশ্মীরে। শ্রীনগর শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে শালিমার বাগ।

জাফরান

ভারতের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত পাহাড়ি জনপদ জম্মু-কাশ্মীর। আয়তন ২,২২,২৩৬ বর্গ কিলো মিটার। শতকরা ৭৭ ভাগ শিক্ষিত লোকের বসতি কাশ্মীরের জনসংখ্যা প্রায় ১,০১,৪৩,০০০ জন। কাশ্মীরি, ডুগরি ও লাদাখি এদের প্রধান ভাষা।

বিশ্বের সর্বাধিক মূল্যবান মসলা জাফরানের জন্মভূমিও কাশ্মীর। ক্ষেতজুড়ে নীলাভ-লাল রংয়ের ছোট ঠোট জাফরান ফুল। গাছে গাছে লাল, সবুজ, হলুদ বা লাল-কমলা মেশানো ডাসা আপেলের দেখা মিলবে এখানেই। ধান ও বার্লি এখানকার উল্লেখযোগ্য ফসল। হাতের নাগালেই পাবেন বিখ্যাত কাশ্মীরী শাল, কার্পেট ও ওলেন কাপড়।

কাশ্মীর বেড়ানোর উপযুক্ত সময় ডিসেম্বর-জানুয়ারি, এপ্রিল-জুলাই এবং সেপ্টেম্বর- অক্টোবর।

জম্মু-কাশ্মীরের শীতকালীন রাজধানী জম্মু ও গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগর। শ্রীনগরে শীতকালে তাপমাত্রা মাইনাস শূন্য ডিগ্রির নিচে নেমে আসে। এখানে পাবেন- ডাল লেক, চরচিনার, শংকর চূড়া, ভিসনোদেবী মন্দির, লাদাখ, হযরত বাল মসজিদ, শালিমারবাগ, লেহ, শোনমার্গ, গুলমার্গ, পহেলাগাঁও, নিশাতবাগ, চশমাশাহী, নাগীনলেক, লালচক, অমরনাথ মন্দির, জিলাম নদী।

শীতকালে কাশ্মীরের তাপমাত্রা মাইনাস ডিগ্রিতে নেমে আসে। তাই পর্যাপ্ত শীতের পোশাক সাথে নিতে হবে কাশ্মীর যেতে চাইলে। কাশ্মীরে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা পাবেন আপনি।

ডাল লেক

শ্রীনগরের নিকটবর্তী একটি নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরা পাহাড়ের পাদদেশে শুয়ে আছে ডাল লেক। ৩ কিলোমিটার প্রস্থ ও ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ এর সীমানা। পাহাড় বেষ্টিত ডাল লেকের রূপ আপনাকে মুগ্ধ করবে। শীতকালে আশপাশের পাহাড়গুলো সাদা আর সাদা। দু’চোখে যেদিকে যায় সেদিকেইা শুধু বরফে ঢাকা পাহাড় চোখে পড়বে।

লেকে ভাসমান সিকারা, হাউজবোট, দোকান, হোটেল সব মিলিয়ে এক অজানা জগতের দেখা মিলবে। একটু দূরে হাতছানি দেবে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পানির লেকের পাড়ে বেড়ে ওঠা বিশাল আকৃতির চিনার আর পাইনেরা।

শীতকালে বেড়াতে গেলে লেকে জলকেলি করতে দেখবেন প্রচুর অতিথি পাখিদের। প্রচণ্ড শীতে কাবু হলেও রাতে ঘুম হবে আরামের। আরামদায়ক ঘুমের আয়োজনে আছে প্রত্যেক হোটেলেই রুম হিটার/ বেড হিটার। মজার মজার সব খাবারের স্বাদের সাথে বাড়তি পাওয়ানা হবে এখানকার মানুষদের আচরণ। শীতকাল পর্যটকশূন্য থাকে ডাল লেক। বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে শীতকালে কাশ্মীরে বেড়াতে আসতে সাহস হয় না অনেকের। কিন্তু একবার ঘুরে আসলে সহজে কেউ ভুলতে পারে না সুন্দরী কাশ্মীরকে।

হযরত বাল মসজিদ

শ্রীনগর শহর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে ডাল লেকের উত্তর পাশে লেকের তীরে অবস্থিত মসজিদটিই বিখ্যাত হযরত বাল মসজিদ। অসংখ্য জালালি কবুতরের আবাস মসজিদের আশপাশে। সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে আরবীয় ডিজাইনে তৈরি করা হয়েছে মসজিদটি। মুসলমানদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে এটি। ১৬৩০ সালে মদিনা থেকে হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর মাথার চুল এনে মসজিদে একটি বিশেষ গ্লাসে রাখা হয়েছে। ধর্মীয় বিশেষ বিশেষ দিনে এই ‘চুল’ ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের দেখানো হয়। এ কারণে মসজিদটি কঠোর নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাক

দৃষ্টিনন্দন মসজিদের চারপাশ শীতকালে বরফাবৃত থাকে।

পহেল গাম

শ্রীনগর শহর থেকে প্রায় ৯৬ কিলো মিটার দূরে এবং সমতল ভূমি থেকে ২১৯৬ মিটার উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় পহেলগাম অবিস্থত। শ্রীনগর থেকে পহেলগাম যাওয়ার পথের প্রাকৃতিক দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। বিশাল আকৃতির পাইন-চিনারগাছ, বরফে ঢাকা জাফরান খেত, ফসলের জমি আর রাস্তা-ঘাট সব বরফের চাদরে ঢাকা। দূরের পাহাড়গুলো ধবধবে সাদা। পাহাড়ি ঝর্ণাধারা পাথর বেয়ে আছড়ে পড়ছে ঐতিহাসিক ঝিলাম নদীতে। কখনও বা পাহাড়। কখনও বা নদী। কখনও বা বড় বড় পাথর। পাহাড়ি বন। বৃক্ষ রাজিতে ঝুলে থাকা বরফ। আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি পথ। গাড়িতে বসে এসব প্রাকৃতিক দৃশ্যের স্বাদ নিতে নিতেই এক সময় দেখা হবে একটি গ্রামের সাথে। প্রকৃতিকন্যা এই গ্রামের নাম পহেলগাম।

গুলমার্গ

শ্রীনগর শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে আজব পাহাড়ের চূড়ায় গুলমার্গ অবস্থিত। এটা সমতল ভূমি থেকে ২ হাজার ৭৩০ মিটার উঁচুতে।

এখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফুলের সমারোহ। শীতকালে যেদিকে তাকাবেন শুধু বরফ আর বরফ। অপরূপ সৌন্দর্য। প্রকৃতি তার সব রূপ এখানে ঢেলে দিয়েছে। শ্রীনগর থেকে গুলমার্গ যাওয়ার পথের দৃশ্যেই আপনার ভ্রমণ পিয়াসী মন কানায় কানায় ভরে যাবে। ঘর, বাড়ি, গাছ-পালা, ফসলের জমি সব কিছুই বরফের নিচে ঢাকা পড়ে শীতকালে। আর সবুজ পাতার সমারোহ যে সব গাছপালায় তার সবগুলোই পাতাশূন্য অবস্থায় দেখা মিলবে শীতে।

ঘরের চালে, বাগানে- চিনার গাছে বরফ ঝুলবে। প্রকৃতির মতেই সুন্দর এখানকার মানুষরাও। গুলমার্গ দেখলেই বুঝতে পারবেন কাশ্মীরকে কেন ভূ-স্বর্গ বলা হয়।

গাড়ি দিয়ে পাহাড় বেয়ে বেয়ে গুলমার্গ যাওয়ার পথের দৃশ্য এবং ভালো লাগার অনুভূতি আপনি কোনোদিন ভুলতে পারবেন না। স্কেটিং, রোপওয়ে দিয়ে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে আসা-যাওয়া আর বরফে গড়াগড়ি দেওয়ার অবাধ সুযোগ তো আছেই।

প্যাহেলগাম

কাশ্মিরের সুন্দর সাজানো শহর শ্রীনগর থেকে ৯৬কি.মি রাস্তার দূরত্বে অত্যন্ত প্রাকৃতিক নৈসর্গমন্ডিত দর্শনীয় স্থান হলো প্যাহেলগাম। প্যাহেলগাম এতোটাই সুন্দর, হৃদয়ছোয়া ও সাজানো গোছানো এলাকা যে মনে হবে সৃষ্টিকর্তার যেন নিজ তত্ত্বাবধায়নে বা উপস্থিতিতে ওই এলাকার পাহাড়, ঝরনা, গাছ-গাছালী, পাহাড় থেকে বরফ গলা পানিতে পাথরের নদী, স্বচ্ছ ও ঠান্ডা পানি, সবমিলিয়ে সামগ্রিম প্রাকৃতিক পরিবেশটাই তৈরী করেছেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বজায় রাখতে প্যাহেলগাম মিউনিসিপ্যাল সেখানে নতুন করে কোন স্থাপনা নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা রেখেছে। প্যাহেলগামে লিডার ভ্যালী অমুশমেন্ট পার্কসহ বিভিন্ন পার্ক রয়েছে। রয়েছে ছোট বড় থেকে ফাইভস্টার হোটেল।