রোহিঙ্গা নির্যাতনের শেষ কোথায়?


মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে যুগযুগ ধরে বসবাস করে আসছে রোহিঙ্গা মুসলমানরা। রোহিঙ্গাদেরকে মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য করছে দেশটির সরকার। তাদেরকে হত্যা-ধর্ষণ,  বাড়ি-ঘর লুটপাট,  অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে । তাদের ওপর যে নির্মম নির্যাতন চলছে তা আইয়ামে জাহেলীয়া যুগের বর্বরতাকেও  হার মানিয়েছে। 

গত শুক্রবার থেকে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী ও মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে শুরু হওয়া সংঘর্ষে শতাধিক লোক নিহত হয়েছে। বলা হচ্ছে গত বছরের অক্টোবরের সহিংসতার পর এ পর্যন্ত এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘাত। জীবন বাচাতে রাখাইন রাজ্য ছাড়ছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা । 

বার্মার সরকারের তরফে বলা হয়েছে ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা লাঠি, ছুরি ও বোমা নিয়ে ওই এলাকায় পুলিশের বেশ কয়েকটি চৌকি ও সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটিতে একযোগে হামলা চালায়। তারপর থেকে দুপক্ষের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) নামে একটি গ্রুপ এ হামলার দায় স্বীকার করেছে।

এ মাসের মাঝামাঝি নিরাপত্তা বাহিনী দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় দমন অভিযান শুরুর পর থেকে পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে। পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসার সময় এ ধরনের দমন অভিযান কাম্য ছিল না। এতে মিয়ানমার সরকারের চিরায়ত রোহিঙ্গা নির্মূলেরই মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে হামলা ও নির্যাতনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার যা করছে তা সভ্যতা-ভব্যতার সব সীমা লঙ্ঘন করেছে।

গত বছর রাখাইনে একটি পুলিশ চেকপোস্টে হামলার পর সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল সেখানে। তখন সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। সরকারী বাহিনীর অভিযানের কারণে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। এবারও সেরকম অবস্থা দেখা যাচ্ছে। রক্তক্ষয়ী সংঘাতের কারণে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। অনেকে গুলিবিদ্ধ ও আহত অবস্থায় বাংলাদেশে ঢুকছে। 

মিয়ানমারের বৌদ্ধ সম্প্রদায় আর দেশটির শাসক গোষ্ঠী রোহিঙ্গা মুসলিমদের সেদেশের নাগরিক বলে স্বীকার করতে চাচ্ছে না। এমনকি তাদেরকে ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ বলে অবহিত করেছে দেশটির সরকার। জানা গেছে, সর্বত্র হারিয়ে নিরাপদ আশ্রায়ের জন্য বাংলাদেশে এসেছেন অনেক রোহিঙ্গা আর আসার অপেক্ষায় ‘নো ম্যানস ল্যান্ডে’ দাঁড়িয়ে আছেন হাজারও  রোহিঙ্গা । যাদেরকে লক্ষ্য করে উভয় পাশ থেকে তাক করে আছে বিজিবি ও বিজিপির বন্দুকের নল। এরই মধ্যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে দু’দেশের সীমান্তে যৌথ অভিযানের প্রস্তাব করেছে ঢাকা। 

গত রোববার সন্ধ্যার পর থেকেই থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে গুলির শব্দ।গতকাল সোমবার সকালে এবং দুপুরেও ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে শোনা গেছে গুলির শব্দ। এমন পরিস্থিতিতেও তাদের পক্ষে কথা বলছেন না মুসলিম উম্মাহর অভিভাবক সৌদি বাদশাহ, কাবার গ্রান্ড মুফতি বা ওআইসি। বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদের ইমাম বা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও দৃঢ় কণ্ঠে কোনো কথা বলছেন না রোহিঙ্গাদের পক্ষে। 

যেন তাদের এই দুনিয়ায় এক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই। তাদের জন্যে বিশ্ব বিবেক নেই। গণতন্ত্রের ত্রাণ কর্তারাও নেই।এমন পরিস্থিতিতে বিবেকবান মানুষের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে ওরা মানুষ না, রোহিঙ্গা । ওদের ওপর নির্যাতনের শেষ কোথায়? 

গণমাধ্যমগুলো বলছে, মিয়ানমারে যা চলছে তা এক কথায় মুসলিম নিধন। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলিরা যা করছে তাই অনুসরণ করছে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সাং সুচির নেতৃত্বে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। কনফুসিয়াসের চীনও নিশ্চুপ, ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা শ্বেত ভল্লুকের দেশ রাশিয়াও নিরব। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম অনুসারী মহাত্মা গান্ধীর ভারত কথা বলছে না, শান্তির আরেক ফেরিওয়ালা দালাইলামা এখন যেন অন্ধ হয়ে আছেন।

এক সময়ে গণতন্ত্রের মুক্তিদূত দাবিদার অং সাং সুচি শান্তিতে পাওয়া নোবেল আঁকড়ে ধরে এখন নিথর হয়ে আছেন। তার আচরণে মনে হচ্ছে, তিনি গণতন্ত্রের জন্য নয়, ক্ষমতার জন্য আন্দোলন করেছেন। আর এখন ক্ষমতা পেয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেত্রী বনে গেছেন। রোহিঙ্গারা যদি ইহুদি হতেন তাহলে মিডিয়া মোগল রুপার্ট মারডকের প্রতিষ্ঠানগুলো সচল হয়ে উঠত। তবে রোহিঙ্গারা খ্রিস্টান না হলেও পোপ ফ্রান্সিস এ জাতি নিধনের নিন্দা জানিয়েছেন।

লেখক: জাকারিয়া শেখ, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।