বাদশাহীর দেশ মরক্কো


আটলান্টিক মহাসাগরের কোল ঘেঁষে আফ্রিকার সবেচেয়ে পশ্চিম সীমান্তের দেশ মরক্কো। উত্তর দিকে মাত্র কয়েক কিলোমিটারের জিব্রাল্টার প্রণালী পেরুলেই ইউরোপ। মুসলিম বিজেতা তারেক এ প্রণালী পার হয়েই স্পেনে অভিযান চালায়। তার নামানুসারে এ প্রণালীর নামকরণ করা হয় জাবাল-এ তারেক। ইউরোপীয়রা আরবি নামের বিকৃত করে এর নাম দেয় জিব্রাল্টার।

দেশটির পূর্বে আলজেরিয়া, দক্ষিনে পশ্চিম-সাহারা ও মৌরিতানিয়া। মজার ব্যাপার হলো দেশটি আফ্রিকান ইউনিয়নের সদস্য নয়, কিন্তু আরব লিগের সদস্য। আরবিতে দেশটির নাম ‘আল-মামলাকা আল-মাগরিবিয়া’। এর অর্থ সর্বপশ্চিমের দেশ। তবে মরক্কো নামটি এসেছে সাবেক রাজধানী মারাকেশের অপভ্রংশ থেকে।

দেশটির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বাদশাহ। তার মতা নিরঙ্কুশ। জনগণও শ্রদ্ধা আর ভক্তির অন্যরকম মহিমায় অভিষিক্ত করেছে রাজপরিবারকে। মরক্কোর রাজপরিবার বিশ্বের প্রাচীন রাজপরিবারের অন্যতম। ষোড়শ শতাব্দীতে রাজপরিবার প্রতিষ্ঠিত হয়। তার পর থেকে প্রকৃতপে মানুষে তাদের মুকুট পরিহিত অবস্থায় দেখতেই পছন্দ করে। বাস, ট্রাম, ট্রেন, উড়োজাহাজ ও রেস্টুরেন্ট মানুষের ঘরবাড়ি কোনো জায়গা পাবেন না, যেখানে বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদের ছবি নেই।

বাদশাহ আর রাজপরিবারের মর্যাদাই অন্যরকম। রাজধানী রাবাতের অভ্যন্তরে বাদশাহর প্রাসাদকে কেন্দ্র করে যেন আরেকটি রাজধাীন। পাইক-পেয়াদা ভৃত্য আর রাজপরিবারের স্টাফদের বাসাবাড়িকে কেন্দ্র করে এক এলাহি কাণ্ড। আবার প্রত্যেকটি শহরে একটি করে রাজপ্রাসাদ রয়েছে।

পত্রিকার স্টলে গিয়ে দেখতে পাবেন প্রথম পাতায় বড় করে ছাপানো রয়েছে বাদশাহর ছবি। দেখে মনে হবে পত্রিকা আর ম্যাগাজিনগুলো শুধু বাদশাহর ছবি ছাপতে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করছে। সবচেয়ে বেশি প্রচারিত পত্রিকা লি মার্টিনের পাতায় পাতায় বাদশাহর সফর, উদ্বোধন আর দৈনন্দিন কাজের ফিরিস্তিতে ভরা। বাদশাহর নামের আগে ‘হিজ ম্যাজেস্টি’ আর ‘এক্সেলেন্সি’ ব্যবহৃত হয় অহরহ। পত্রিকার পক্ষ থেকে তার জন্য দোয়াও চাওয়া হয়। আমরা সবসময় দেখেছি কেবল ধরাধাম ত্যাগের পরই কারো নামে রাস্তা বা কোনো উল্লেখযোগ্য স্থাপনার নামকরণ করা হয়। অবাক হবেন তরুণ বাদশাহ মোহাম্মদের নামে এখনই রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। স্পষ্ট অরে লেখা রয়েছে বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদ রোড।

বাদশাহ এখানে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৯৬ সালে প্রণিত সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রী পরিষদের নিয়োগ দেন বাদশাহ। তিনি মন্ত্রিসভার সবধরনের সভায়ও হাজির থাকতে পারবেন। রাজপরিবার বা বাদশাহর সমালোচনা করার অধিকার নেই নির্বাচিত সংসদ সদস্যদেরও। তিনি বিচারকদের নিয়োগ দেন। ম্যাজিস্ট্রেটদের হাই কাউন্সিলে সভাপতিত্ব করেন। তিনি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান। তার পদবি হচ্ছে ‘কমান্ডার অব দ্য ফেইথফুল’। তিনি সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা তার হাতেই রয়েছে।

 

এক নজরে মরক্কো

দেশের নাম : দ্য কিংডম অব মরক্কো

জনসংখ্যা : ৩ কোটি ১৬ লাখ (জাতিসঙ্ঘ ২০০৫ অনুসারে)

রাজধানী : রাবাত

আয়তন : ৭ লাখ ১১ হাজার বর্গ কিলোমিাটার প্রায়

প্রধান ভাষা : আরবি বারবার ফ্রেঞ্চ স্পেনিস

প্রধান ধর্ম : ইসলাম

গড় আয়ু : ৬৭ বছর (পুরুষ) ৭২ বছর (মহিলা)

মুদ্রা : দিরহাম

প্রধান রপ্তানি : খনিজদ্রব্য, সামুদ্রিক মাছ থেকে তৈরি খাদ্য ও ফল

মাথাপিছু আয় : ৭৩০ মার্কিন ডলার

 

খ্রিষ্টপূর্ব ৮ হাজার বছর আগে মরক্কোয় জনবসতি গড়ে ওঠে। তখন দেশটি অনুর্বর আর বৃষ্টিপাতহীন শুষ্ক মরুভূমি ছিল। বারবার, ফোনেশীয়, ইহুদি ও সাব-সাহারার লোকেরা ক্রমান্বয়ে বসতি গড়ে এখানে। শুরু থেকেই বারবারদের প্রাধান্য ছিল। ফোনেশীয়রা ছিল বণিক জাতি, প্রচীনকালে তারাও কিছুটা প্রাধান্য বিস্তার করে। ফলে রোমানদের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। এক পর্যায়ে এটি রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। পঞ্চম শতকে রোমানরা সরে গেলে পূর্ব জার্মান বংশোদ্ভূত ভেন্ডাল আর গ্রিক বাইজেন্টাইনরা পর্যায়ক্রমে প্রভুত্ব করে দেশটিতে। তবে বিস্তৃত মরক্কোর বেশিরভাগ অংশই ছিল বারবারদের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। বিচ্ছিন্নভাবে তারা বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত।

দামেস্কের উমাইয়া খেলাফতের আদেশে উকবা ইবনে নাফির নেতৃত্বে মরক্কোয় অভিযান চালানো হয়। ৬৭০ সালে তারা দেশটিতে প্রবেশ করে। দীর্ঘ ১০০ বছরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও কলোনিকে একত্র করে একটি রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। ইসলাম নিয়ে আসে এখানে উন্নত সংস্কৃতি আর জীবনাচরণ। ইসলামের আলোকে গঠিত হয় একটি নতুন সমাজ। ব্যাপকহারে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। উন্নত আরবীয় সংস্কৃতি ছাপিয়ে যায় বারবার আর যাযাবর জীবন। ১৬৬৬ সালে বর্তমান বাদশাহদের পূর্বপুরুষরা মতায় আসার আগের কয়েকশ বছরে দেশটিতে নানান উত্থান পতন হয়। আব্বাস ও উমাইয়া খেলাফতের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন যায়গায় ভিন্ন ভিন্ন রাজত্বের উদ্ভব ঘটে। শেষের দিকে স্পেনে মুসলমানদের পতন দারুণভাবে প্রভাবিত করে দেশটিকে। খ্রিষ্টান আগ্রাসনের ছোঁয়া লাগে মরক্কোয়। আগ্রাসনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ১৬৬৬ সালে আলউতি রাজবংশ (বর্তমান রাজবংশ) দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে প্রথম স্বীকৃতিদাতা দেশ মরক্কো। দেশটি স্বাধীনতা ঘোষণা করার পরপরই ১৭৭৭ সালে তারা এ ঘোষণা দেয়। আটলান্টিক সাগরে মার্কিন জাহাজকে জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করে তারা। একই সালের ২০ ডিসেম্বর মরক্কোর সুলতান তৃতীয় মোহাম্মদ মার্কিন সমুদ্র জাহাজকে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়ার অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। অবাক হওয়ার মতো বিষয় ইউরোপীয় দেশগুলোর বিরুদ্ধে গিয়ে আটলান্টিকের বুকে মার্কিন জাহাজকে নিরাপত্তা দেয়ার মতো মতা ছিল দেশটির। এ উপলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিত্রতার চুক্তি সম্পাদিত হয়। দেশ দু’টির মধ্যে এই মিত্র সম্পর্ক এখনো অব্যাহত রয়েছে। মার্কিনিরা যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে এ মৈত্রী চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করে নেয়। বিশ শতকের শুরুর দিকে ঔপনিবেশিক কূটচালে পড়ে বাদশাহ চতুর্থ আবদুল আজিজ দেশবাসীর বিরাগভাজন হন।

১৯০৮ সালে তিনি পদচ্যুত হন। মতায় আসেন তার ভাই আবদুল হাফিজ। কিন্তু ১৯১২ সালে ফ্রান্স দেশটির কর্তৃত্ব নিয়ে নিলে তিনিও পদচ্যুত হন। এ সময় রাজবংশের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে ফ্রান্স দেশটিতে প্রভুত্ব করে। একজনকে মতায় বসান আবার ইচ্ছেমতো তাকে অপসারণ করায়। ফ্রান্স এবং স্পেনের মাঝে চুক্তির মাধ্যমে দেশটি কর্তৃত্ব নির্ধারিত হয়। বাদশাহ পঞ্চম মোহাম্মদের ক্ষমতারোহণ পর্যন্ত পশ্চিমাদের মধ্যে দেশটি নিয়ে নানামুখী খেলা চলে। মোহাম্মদের মৃত্যুর পর তার ছেলে বাদশাহ দ্বিতীয় হাসানের মতা আরোহণের মধ্যে দিয়ে ইউরোপীয়দের প্রভাব সম্পূর্ণ রহিত হয়। তিনি দোর্দণ্ড প্রতাপে ১৯৬১ থেকে মৃত্যুপূর্ববর্তী ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত দেশটি শাসন করেন। হাসানের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকলেও দেশটির একতা বজায় রেখে নিরবচ্ছিন্ন সমৃদ্ধি অর্জন করার কৃতিত্বের দাবিদার তিনি। এরপর রাজমুকুট পরেন তরুণ শাহজাদা ষষ্ঠ মোহাম্মদ।

মরক্কো ১৬টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত। এগুলোকে আবার ৬২টি প্রদেশে ভাগ করা হয়েছে। পাশে অবস্থিত পশ্চিম সাহারার কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধ চলছে। ৭ লাখ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ দেশটি বিশ্বের ৫৭তম বৃহৎ দেশ। ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত কয়েকটি দ্বীপ নিয়ে স্পেনের সাথে বিরোধ রয়েছে। সর্বশেষ পেরিজিল (মরক্কোর নাম লায়লা) নিয়ে দেশ দু’টির মাঝে উত্তেজনা দেখা দেয়। দেশের পশ্চিম অংশে জুড়ে রয়েছে এটলাস পর্বতমালা। দণি-পশ্চিমাঞ্চলের বড় অংশজুড়ে সাহারা মরুভূমি। বেশিরভাগ মানুষের বাস উর্বর ভূমধ্যসাগরের উপকূলরেখা জুড়ে। দেশটির রাজধানী রাবাত, কিন্তু সবচেয়ে বড় শহর বন্দরনগরী কাসাব্লাঙ্কা। দেশটিতে ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু বিরাজমান। তবে পর্বতাঞ্চলে চরমভাবাপন্ন জলবায়ু দেখা যায়। সমুদ্র উপকূলের মাটি অত্যন্ত উর্বর। দেশটির আয়তনের ১২ শতাংশ বনভূমি আর চাষাবাদের উপযোগী ভূমি ১৮ শতাংশ। আবাদ হয় পাঁচ শতাংশ জমিতে। নানান প্রাণী আর উদ্ভিদ দেশটির প্রকৃতিকে করেছে বৈচিত্র্যময়। ৩২টি দুর্লভ প্রজাতির প্রাণীর বসবাস এখানে। দেশটি বিচিত্র ধরনের পাখির জন্যও বিখ্যাত।

মরক্কোর সশস্ত্র বাহিনীর আকারও বেশ বড়। সদস্যসংখ্যা প্রায় ২ লাখ। রিজার্ভ সেনাসদস্য রয়েছে দেড় লক্ষাধিক। নিয়মিত স্থলবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ১ লাখ ৭৫ হাজার। বিমান বাহিনী সাড়ে ১৩ হাজার ও নৌবাহিনীর সদস্যসংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। ৫২০টি ট্যাঙ্ক, ১০০টি হালকা ট্যাঙ্ক রয়েছে সামরিক বহরে। দু’ট ফ্রিগেট রয়েছে। আছে ৯৫টি যুদ্ধবিমান। দেশটিতে ৫০ হাজার আধাসামরিক সদস্য রয়েছে। দেশটির প্রতিরক্ষা খাতে দেড়শ’ কোটি ডলারের মতো ব্যয় হয়। এটি জাতীয় উৎপাদনের প্রায় চার শতাংশ।

অর্থনৈতিকভাবে আফ্রিকার পঞ্চম শক্তিশালী দেশে মরক্কো। দেশটির বার্ষিক জাতীয় উৎপাদন ১৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ। ফসফেটের সবচেয়ে বড় খনি রয়েছে দেশটিতে। প্রবাসীদর পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম আয়ের উৎস। পর্যটন এ দেশের তৃতীয় বৃহৎ আয়ের যোগানদাতা। ১৯ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। প্রতি ১টি হাজার পরিবারের মধ্যে ২৪৩টি পরিবারে টেলিভিশন রয়েছে। দেশটির সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী ছিল বারবার। আরবদের আগমনের পর তারা ব্যাপক মাত্রায় মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে। পরে আরবীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করে। একজন আরব আর বংশগত একজন বারবারের মধ্যে এখন তেমন কোনো পার্থক্য নেই। মরক্কোর অফিসিয়াল ভাষা আরবি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো কিছু বারবার ভাষা প্রচলিত রয়েছে। ফ্রেঞ্চ দ্বিতীয় প্রধান ভাষার মর্যাদা পেয়েছে দেশটিতে। স্পেনিশ ভাষাও বেশ প্রচলিত। দেশটিতে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতির জন্য ইউনেস্কো দেশটিকে ২০০৬ সালে পুরস্কৃত করে। মরক্কোয় ১৪টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোতে প্রায় আড়াই লাখ ছাত্র অধ্যয়ন করে।

প্রজন্মনিউজ২৪/মাহমুদুল