ব্যবসায়ে ভেজাল ও প্রতারণার মূলোৎপাটনে ইসলাম

প্রকাশিত: ০৮ জানুয়ারী, ২০২০ ১০:৪১:৪৫

ব্যবসায়ে ভেজাল ও প্রতারণার মূলোৎপাটনে ইসলাম

“খাদ্যে ভেজাল ঔষধে ভেজাল ঘুনেধরা এ সমাজ

সবখানেতেই সয়লাব যেন ঠকবাজ আর ধোঁকাবাজ।”

ইতিবাচক ও কল্যাণকর জীবনাদর্শ হলো ইসলাম। সর্বদাই ইসলামের অবস্থান সকল প্রকার ক্ষতি, অকল্যাণ, ভেজাল, দুর্নীতি ও প্রতারণার বিরূদ্ধে। আল্লাহ তায়ালা ব্যবসা-বাণিজ্যকে হালাল করেছেন এবং সুদ, ঘুষ ও প্রতারণাকে হারাম করেছেন। কোনো ব্যবসায়ী যদি হালালভাবে সততা ও বিশ্বস্ততার সাথে ব্যবসা করে তবে তিনি নবি, সিদ্দীকীন ও শহীদগণের সাথে জান্নাতে থাকবেন। মুত্তাকী, নেককার ও সৎ ব্যবসায়ী ছাড়া বাকী সকল ব্যবসায়ীকেই কিয়ামতের দিন পাপীরূপে উঠানো হবে।


আজ বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, আল্লাহ তায়ালার ভয়, নেক আমল এবং সততা যেন আমরা ভুলতে বসেছি। আমাদের জীবন ঘনিষ্ট সব কিছুতেই আজ ভেজাল, দুর্নীতি ও প্রতারণার সয়লাব। ভেজালের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মানুষের জীবন রক্ষাকারী খাদ্য দ্রব্যেও বিষাক্ত ভেজাল মিশাতে অসাধু ব্যবসায়ীদের হৃদয় এতটুকু কাঁপছে না। যা অত্যন্ত ঘৃণ্য ও নিন্দনীয়।


তবে ইসলামের বিচারে এহেন কাজ অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক, মানবতা বিরোধী ও নিফাকী আচরণ। এ ঘৃণ্য কাজগুলো মুনাফিকের দ্বারাই সম্ভব। যারা আল্লাহর সাথে ধোঁকাবাজি করে। যারা মিথ্যাবাদী ও পাপাচারী। এদের স্থান হবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে এবং তাদের কোনো সাহায্যকারী সেই দিন তথা পূণরোত্থানের দিন থাকবে না।


যে সকল ব্যবসায়ী খাদ্যে জীবন বিনাশী নানা রকম ভেজাল ও ক্যামিক্যাল মিশাচ্ছে তাদের একটি বড় অংশ মুসলিম। এদের অনেকে আবার মসজিদে গিয়ে হাজিরাও দেয়। আল্লাহর পথে দান-খয়রাতও করে। কিন্তু তারা জানে না যে, মানুষের ক্ষতি করা হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক নষ্ট করার শামীল। যা কবীরা গুনাহ। হক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক্ব আল্লাহ চাইলে ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক্ব আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। এ থেকে বুঝা যায়, এটি কত বড় গুরুতর অপরাধ।


পণ্যের দোষ গোপন করলে বা পণ্যের ব্যাপারে মিথ্যা বললে ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত নষ্ট হয়ে যাবে। যেমন-রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- “যতক্ষণ বিচ্ছিন্ন না হবে ততক্ষণ ক্রেতা-বিক্রেতার পণ্য ফেরতের ইখতিয়ার থাকবে। যদি তারা সত্য বলে ও পণ্যের যথাযথ অবস্থা বর্ণনা করে তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে,  আর যদি পণ্যের প্রকৃত অবস্থা গোপন করে ও মিথ্যা বলে তবে ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত চলে যাবে।” (সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ১৯৭৩)


যারা পণ্য বিক্রয়ে ধোঁকা-প্রতারণার আশ্রয় নেয় তারা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর উম্মত নয় বলে হাদীসে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদের দিকে তাকাবেন না। তাদেরকে তিনি পবিত্র করবেন না। উপরন্তু তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।


মানুষকে কষ্ট দেয়ার আরেক ন্যাক্কারজনক কাজ হলো অবৈধ মজুতদারী। মজুতদাররা তাদের ইচ্ছামত মুনাফা লাভের জন্য পণ্যসামগ্রী আটকে রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়। ফলে মানুষ অবর্ণনীয় কষ্টের সম্মুখীন হয়। তাদের নৈতিক স্খলন এতটাই ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, লক্ষ লক্ষ টন খাদ্যদ্রব্য গুদামে রেখে পঁচিয়ে ফেলতে তাদের হৃদয় একটুও কাঁপে না। এ যে কত বড় পাপাচার তা তারা মনেই করে না। পাপাচারী ছাড়া কেউ মজুতদারী করে না। অবৈধ মজুতদারীরা অভিশপ্ত। তাদের উপর অভিশাপ দেয় অসংখ্য বনী আদম। অবাধ ব্যবসায়ী অনুগ্রহ প্রাপ্ত এবং মজুতদার অভিশপ্ত। মজুতদারদের জন্য আল্লাহ তায়ালা কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছেন। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে তাদেরকে কুষ্ঠরোগ ও দারিদ্র দিয়ে শাস্তি দেন।


ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়কে প্রতারিত করার আরেক অপকৌশলের নাম দালালী। আমরা হাট-বাজারে এদের কাছে জিম্মী। এরা মধ্যস্বত্ত্বভোগী একটি অযাচিত শ্রেণি। রাসূলুল্লাহ (সা.) এ পেশায় জড়াতে নিষেধ করে বলেছেন- “কোনো ব্যক্তি তার ভাইয়ের ক্রয়-বিক্রয়ের কথার উপর নিজে ক্রয়-বিক্রয়ের কথা বলবে না। গ্রাম্যলোকের পণ্য-দ্রব্য শহরের লোকগণ বিক্রয় করে দেবে না, দালালী করবে না, কোনো ভাইয়ের বিক্রয়ের উপর মুল্য বৃদ্ধি করবে না।” (সুনান আন-নাসায়ী, খন্ড-৭, পৃ. ২৫৬, কিতাবুল বুয়ু, হাদীস নং ৪৪৯৬)


প্রতারণার আরেক দিক হলো ওজনে কম দেয়া। আজকাল ওজনে কম দেয়া আমাদের সমাজে একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রেতার সামনেই অত্যন্ত সুকৌশলে ওজনে কম দেয়া হচ্ছে অথচ ক্রেতা এ কারসাজি বুঝতেই পারে না। আল-কুরআনে এ ব্যাপারে কঠোর সাবধান বাণী ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- “ধ্বংস তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়, যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে এবং যখন ওদের জন্য মেপে অথবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়। (সূরা আল-মুতাফফিফীন, আয়াত: ১-৬) অন্যত্র আরো বলা হয়েছে- “তোমরা মাপে ও ওজনে কম করো না; আমি তোমাদেরকে সমৃদ্ধশালী দেখছি, কিন্তু আমি তোমাদের জন্য আশঙ্কা করছি এক সর্বগ্রাসী দিনের শাস্তির। হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা ন্যায় সংগতভাবে মেপো ও ওজন করো, লোকদেরকে তাদের প্রাপ্য বস্তু কম দিওনা এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।” (আল-কুরআন, সূরা হুদ, আয়াত: ৮৪-৮৫)


আলোচনার প্রান্তটিকায় এসে বলতে পারি যে, ভেজাল নকল মজুতদারী মধ্যস্বত্ত্বভোগ ও প্রতারণার মূলোৎপাটনে ইসলামের ভূমিকা সুস্পষ্ট। প্রতিটি মুসলমানের ব্যবসা-বাণিজ্য অত্যন্ত সতর্কতার সাথে করা উচিত। এটাই ঈমানের দাবী। অন্যথায় দুনিয়া-আখিরাত উভয় জাহানে শাস্তি অবধারিত। আল্লাহ আমাদেরকে ব্যবসায়ে ভেজাল নকল মজুতদারী দালালী ও প্রতারণা করা থেকে বিরত থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।

 

ইমদাদুল হক যুবায়ের

গবেষক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক

zubairjcpsc@gmail.com

 

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন