জিপিএ-৫ নিয়ে যত কথা

প্রকাশিত: ০৫ জানুয়ারী, ২০২০ ০৩:০৬:৫২ || পরিবর্তিত: ০৫ জানুয়ারী, ২০২০ ০৩:০৬:৫২

জিপিএ-৫ নিয়ে যত কথা

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ সালের প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট পরীক্ষার ফলাফল। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় পাসের হার ৯৫ এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় এর হার ৮৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। এ বছর প্রাথমিকে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ লাখ ২৬ হাজার এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় এই সংখ্যা ৭৮ হাজার ৮২৯।

প্রতিবারের মতো এবারও প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ফলাফলের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়েছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আলাপ-আলোচনা করেছে ফলাফলের বিভিন্ন দিক, শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষার গুণগত মান এবং শিক্ষাদানের পদ্ধতি নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছিল যথারীতি ফলাফল-সংক্রান্ত নানান আলাপ। জিপিএ-৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের পোস্টে সন্তানকে নিয়ে আনন্দ ও গর্বের বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। অন্যদিকে জিপিএ-৫ না পাওয়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের অনেকের পোস্টে সুস্পষ্টভাবে কিংবা সুপ্তভাবে প্রতিফলিত হয়েছে হতাশার বিষয়টি। যদিও কেউ কেউ বলেছেন, সন্তান জিপিএ-৫ না পাওয়াতে তাঁদের আক্ষেপ নেই, কিন্তু হতাশার বিষয়টি বুঝতে বেগ পেতে হয় না। কেউবা আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফলাও করে ফলাফল জানানোর এই প্রবণতাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। এ ছাড়াও বিদ্যমান পরীক্ষাপদ্ধতি, ফলাফলের মানদণ্ড, শিক্ষার ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে লিখেছেন অনেকেই।

এসব দেখেশুনে কেবলই মনে হচ্ছে, এক গোলকধাঁধায় পড়ে গেছি আমরা। জিপিএ-৫ প্রাপ্তি-নির্ভর শিক্ষাদানের পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে বলার আর কিছুই নেই। শিক্ষাদানের এই পদ্ধতি কেড়ে নিচ্ছে শিশুদের রঙিন শৈশব। তারা যেন জিপিএ-৫ উৎপাদনের কাঁচামালের জোগান দেওয়া একেকটি যন্ত্রমানব। এই যন্ত্রমানবেরা সবাই অবতীর্ণ হয়েছে এক দৌড় প্রতিযোগিতায়। যন্ত্রগুলো যেন কার্যকরভাবে দৌড়াতে পারে, তার রসদ জোগাড় করা নিয়ে ব্যস্ত অভিভাবকেরা। আবার কেউবা রেসের বাইরে থেকে কেবলই হাততালি দিচ্ছেন আর মজা নিচ্ছেন। মাঝখান দিয়ে গাইড বই আর কোচিং সেন্টারগুলো রমরমা ব্যবসা করছে, আর শিক্ষার্থীরা পড়ার চাপে হাঁসফাঁস করছে।

ফলাফল প্রকাশ-পরবর্তী ফেসবুক স্ট্যাটাসগুলো পর্যালোচনা করে আমার মনে হয়েছে, ফলাফল নিয়েও যেন কাদা ছোড়াছুড়িতে মত্ত হয়েছি আমরা। খুবই অধৈর্য এবং অপরিণত আমাদের নেই পারস্পরিক সম্মান এবং শ্রদ্ধাবোধটুকুও। সন্তানের ভালো ফলাফলে পিতা-মাতা-অভিভাবক খুশি হবেন, গর্বিত হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। ফল প্রকাশের পর সন্তোষের কথা সবাইকে জানানোই স্বাভাবিক প্রবণতা। সামাজিক মাধ্যম হাতের মুঠোয় থাকায় এখন যেকোনো তথ্যের প্রচার অনেক সহজ। আমরা যে সময় বেড়ে উঠেছি, সে সময় ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়তো ছিল না। কিন্তু সম্ভাব্য সব মাধ্যম যেমন চিঠি লিখে, টেলিফোন করে, দূরবর্তী স্থানে ট্রাংকল বুকিং করে অভিভাবকেরা তাঁদের নিজস্ব গণ্ডিতে আত্মীয়স্বজনকে সন্তানের ফলাফলের বিষয়টি জানাতেন। মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া শিক্ষার্থীদের সে সময় ইন্টারভিউ করা হতো, সংবাদপত্রে তার ভালো ফলাফলের গল্প ছাপানো হতো। সেটি যদি সবার কাছে অনুপ্রেরণা হতে পারে, তবে আজকে সামান্য ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমে জিপিএ-৫ পাওয়ার বিষয়টি জানানো নিয়ে কেন আমাদের এত মতপার্থক্য!

অন্যের ভালো কিংবা মন্দকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে না পারা এক ধরনের দৈন্য নয় কি? এ যেন এক জটিল চক্র। জিপিএ-৫-এর সহজলভ্যতার কারণে জিপিএ-৫ না পেলে যেমন শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক মুষড়ে পড়ছেন। অন্যদিকে জিপিএ ৫ পেলেও যেন শান্তি নেই। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে কেউ কেউ মন্তব্য করে বসেন, ‘এ আর এমন কী! আজকাল জিপিএ-৫ সবাই পায়।’ তাঁদের মন্তব্যে মনে হয় জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে যেন শিক্ষার্থীর কোনো গৌরব নেই, নেই কোনো কৃতিত্ব। এ যেন পুরোপুরিই শিক্ষাপদ্ধতির দয়ার দান। এ ধরনের কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্তব্যের কারণে ভালো ফল করেও শিক্ষার্থী এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভুগছে এবং তার আত্মবিশ্বাসে টান পড়ছে। জিপিএ-৫ পেয়েও সে যেন অপরাধী। আর জিপিএ-৫ না পেলে তো কথাই নেই। মুখ দেখানোই যেন দায় হয়ে পড়ছে অভিভাবকদের। আর শিক্ষার্থীর অবস্থা আর নাই বা বললাম। এই লেজেগোবরে শিক্ষাব্যবস্থায় ভালো ফল করেও যেমন প্রাপ্তির আনন্দ নেই, তেমনি সামান্য খারাপ ফল করলেও মুখ দেখানোর জো নেই। ভালো আর মন্দ ফলাফলের বর্তমান এই অন্তঃসারশূন্য মানদণ্ডটি জেঁকে বসে কীভাবে যেন সব গ্রাস করে ফেলছে।

ফলাফল প্রকাশের পর জিপিএ-৫ পাওয়া আর না-পাওয়া উভয় শিক্ষার্থীই মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগছে। কেউই ভালো নেই এভাবে। ভালো নেই শিক্ষার্থীরা, ভালো নেই শিক্ষকেরা, ভালো নেই অভিভাবকেরা। তাই সন্তানের প্রকৃত শিক্ষা লাভের জন্য একদিকে যেমন পরীক্ষাপদ্ধতির সংস্কার জরুরি, অন্যদিকে প্রয়োজন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মানসিকতার পরিবর্তন। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, স্কুল কর্তৃপক্ষও বিষয়গুলো তলিয়ে দেখে না। উপরন্তু তারা শিক্ষার্থী নিয়ে তুলনামূলক নানা আলোচনার মাধ্যমে অভিভাবকদের আরও অসহিষ্ণু করে তোলে, যার প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন স্কুলগুলোর সংবেদনশীল আচরণ, প্রয়োজন অভিভাবকদের কাউন্সেলিং। আর সন্তান যে গ্রেডই পাক না কেন, সেটিকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া প্রয়োজন অন্যের ভালো কিংবা খারাপকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারার যোগ্যতা অর্জন করা। সবার আবেগ অনুভূতির প্রকাশও এক রকম নয়। তাই সন্তানের অর্জনে কিংবা তার ব্যর্থতায় কেউ প্রতিক্রিয়া দেখালে সেটিও স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মানবিক ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি করা; জিপিএ-৫ প্রাপ্তি নয়। নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক

প্রজন্মনিউজ২৪/জাহিদ

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



A PHP Error was encountered

Severity: Notice

Message: Undefined index: category

Filename: blog/details.php

Line Number: 417

Backtrace:

File: /home/projonmonews24/public_html/application/views/blog/details.php
Line: 417
Function: _error_handler

File: /home/projonmonews24/public_html/application/views/template.php
Line: 199
Function: view

File: /home/projonmonews24/public_html/application/controllers/Article.php
Line: 87
Function: view

File: /home/projonmonews24/public_html/index.php
Line: 315
Function: require_once

বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ