আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস ও শ্রমের মর্যাদা

প্রকাশিত: ০২ মে, ২০১৯ ০৪:২২:২৬ || পরিবর্তিত: ০২ মে, ২০১৯ ০৪:২২:২৬

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস ও শ্রমের মর্যাদা

বিশ্বব্যাপী আজ প্রযুক্তির জয়গান ধ্বনিত। চোখধাঁধানো স্থাপত্যকলা, কারুকার্যখচিত শিল্পের ছোঁয়া, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষকাল অতিক্রম করছি বর্তমানে আমরা । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সোনালী যুগ বলা হয় বর্তমান সময়কে । এ অর্জন ও উৎকর্ষের নেপথ্যে কিছু ত্যাগ রয়েছে। রয়েছে কিছু শ্রম বিসর্জন।

শ্রমশিল্পের ভাষায়, কোনো বস্তু ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠা কিংবা কোনো ধরনের উৎকর্ষ আমাদের জন্য উপকারী তখনই হয়, যখন তা কোনো শ্রমের বিসর্জনে অর্জিত বা নির্মিত হয়। মোটকথা, বস্তু ব্যবহারযোগ্য কিংবা উপকারী হয়ে ওঠার নেপথ্যে শ্রমই প্রথম ও প্রধান উপাদান।

সকাল-সন্ধ্যা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শ্রমিকরা কতভাবে যে এই বিশ্বকে সচল রেখেছেন, সমুন্নত রেখেছেন উন্নয়নের এই ধারাকে, তার সঠিক পরিসংখ্যান অসম্ভব। শ্রমজীবী এই সমাজটি না থাকলে অচল হয়ে যেত এসব উৎকর্ষ। থেমে যেত আমাদের জীবনধারা। মুহূর্তের মাঝে মাটিতে মিশে যেত- আকাশচুম্বী এতো সব গৌরব। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, সঠিকভাবে হিসাব নিলে দেখা যাবে যে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বঞ্চনার শিকার হয় এই শ্রমজীবী মানুষগুলো।

সবচেয়ে বেশি মূল্যহীন ও মানহীন জীবন যাপন করেন পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষ। শ্রমজীবী মানুষ বা শ্রমিকদের শোষণ ও নিপীড়নের এই সমস্যা মামুলি কিংবা এক-দুদিনে সৃষ্ট কোনো সমস্যা নয়, বহুকাল ধরে চলে আসছে এই অত্যাচার, জারি রয়েছে এই বঞ্চনা। দিন দিন বেড়েই চলছে নিগৃহীত শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা।

ইতিহাসের পাতায় মে দিবস

১৮৮৬ সালের ১লা মে আমেরিকার মেহনতী শ্রমিকশ্রেণী দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীসহ আরো কয়েকটি ন্যায্য দাবী ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জীবন বিসর্জন দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা করেছিল। ১লা মে’র ওই ধর্মঘট দিবসের আগে যুক্তরাষ্ট্র বা বিশ্বের কোথাও শ্রমনীতি বা শ্রমিক আইন ছিল না। শ্রমিকদের মানবিক ও অর্থনৈতিক অধিকার বলতেও কিছু ছিল না।

তারা ছিল মালিকদের দাস মাত্র। তাদের কাজের কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা ছিল না। ছিল না সাপ্তাহিক কোন ছুটিও। ছিল না চাকুরীর স্থায়ীত্ব ও ন্যায়সঙ্গত মজুরীর নিশ্চয়তা। মালিকরা তাদের ইচ্ছামত শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিত। এমনকি দৈনিক ১৮-২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতেও বাধ্য করত শ্রমিকদের। এ অন্যায়, বঞ্চনা ও জুলুমের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা পর্যায়ক্রমে তীর্ব আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।

এ আন্দোলনের অংশ হিসাবে আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার -এর ১৮৮৫ সালের সম্মেলনের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীতে ১৮৮৬ সালের ১লা মে আমেরিকা ও কানাডার প্রায় তিন লক্ষাধিক শ্রমিক শিকাগোর হে মার্কেটে ঢালাই শ্রমিক, তরুণ নেতা এইচ সিলভিসের নেতৃত্বে এক বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে সর্বপ্রথম সর্বাত্মক শ্রমিক ধর্মঘট পালন করে।

শ্রমিকদের সমাবেশ চলাকালে মালিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী পুলিশ ও কতিপয় ভাড়াটিয়া গুণ্ডা সম্পূর্ণ বিনা উস্কানীতে অতর্কিতভাবে গুলী চালিয়ে ৬ জন শ্রমিককে নৃশংসভাবে হত্যা ও শতাধিক শ্রমিককে আহত করে। কিন্তু এতেও শ্রমিকরা দমে যায়নি। শ্রমিকদের ইস্পাতকঠিন সফল ধর্মঘটের কারণে কোন কোন মালিক ৮ ঘণ্টা কর্ম সময়ের দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়। ফলে শ্রমিকরা আরো উৎসাহী ও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠে এবং সর্বস্তরে ৮ ঘণ্টা কর্ম সময়ের দাবী প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২রা মে রবিবারের সাপ্তাহিক বন্ধের দিনের পর ৩ তারিখেও ধর্মঘট অব্যাহত রাখে।

নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আয়োজিত ৪ঠা মে শিকাগো শহরের হে মার্কেটের বিশাল শ্রমিক সমাবেশে আবারো মালিকগোষ্ঠীর গুণ্ডা ও পুলিশ বাহিনী বেপরোয়াভাবে গুলী বর্ষণ করে। এতে ৪ জন শ্রমিক নিহত ও বিপুল সংখ্যক আহত হয়। রক্তে রঞ্জিত হয় হে মার্কেট চত্বর।

গ্রেফতার করা হয় শ্রমিক নেতা স্পাইজ ও ফিলডেনকে। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে রীতিমত চিরুনী অভিযান চালিয়ে শিকাগো শহর ও এর আশপাশের এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী ফিশার, লুইস, জর্জ এঞ্জেল, মাইকেল স্কোয়ার ও নীবেসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ শ্রমিক নেতাকে।

পরবর্তীতে শ্রমিকদের এই ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের বিরোধিতাকারী মালিকপক্ষের ব্যক্তিদের সমন্বয়ে জুরি বোর্ড গঠন করে ১৮৮৬ সালের ২১ জুন শুরু করা হয় বিচারের নামে প্রহসন। একতরফা বিচারের মাধ্যমে ১৮৮৬ সালের ৯ অক্টোবর ঘোষিত হয় বিচারের রায়।

রায়ে বিশ্বজনমতকে উপেক্ষা করে শ্রমিক নেতা পার্সন্স, ফিলডেন, স্পাইজ, লুইস, স্কোয়ার, এঞ্জেল ও ফিশারের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ প্রদান করা হয় এবং ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর সে আদেশ কার্যকর করা হয়। শ্রমিক নেতা ও কর্মী হত্যার এ দিবসটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে প্রতিবছর ১লা মে শ্রমিক হত্যা দিবস ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

দৈনিক ৮ ঘণ্টা কার্য সময় ও সপ্তাহে এক দিন সাধারণ ছুটি প্রদানের ব্যবস্থা করে প্রথম শ্রম আইন প্রণীত হয়। অন্যদিকে নারকীয় এ হত্যাযজ্ঞ গোটা বিশ্বের শ্রমিকদের অধিকারে এনে দেয় নতুন গতি। শিকাগো শহরে সৃষ্ট এ আন্দোলন ক্রমশ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়।

পৃথিবীর সকল শ্রমজীবী মানুষ এ আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয় দুনিয়ার মজদুর এক হও শ্লোগানটি। শতাব্দিরও আগে ঘটে যাওয়া সে ঘটনাটির কথা এখন প্রতিবছর বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণ করা হয়ে থাকে বিশ্ব শ্রমিক দিবস বা মে দিবস হিসাবে।

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিকের অধিকারঃ

ইসলাম বরাবরের মত শ্রমিকের অধিকার আদায়ে সোচ্চার। শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য প্রাপ্য না দেওয়ার ভয়াবহতার বর্ণনা দিতে গিয়ে রাসুল স.  বলেছেন, 'ভয়াবহ কিয়ামতের দিন কিছু লোক আমার মমতাময়ী আশ্রয় থেকে বঞ্চিত থাকবে।' সাহাবা আজমাইন জিজ্ঞেস করলেন, কারা সেই হতভাগা? নবিজি (সা.) বললেন, 'নির্ধারিত পারিশ্রমিক দেওয়ার চুক্তিতে শ্রমিক নিয়োগ করার পর কাজ শেষে যারা পূর্ণ পারিশ্রমিক প্রদান করে না।(বুখারি ও মুসলিম)।শ্রমিকের ন্যায্য হিস্যা যথাসময়ে আদয় করতে নির্দেশ দিয়ে রাসুল (স) আরও বলেন - তোমরা শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও। (আব্দল্লাহ ইবনে উমর রা. বর্ণিত-ইবনে মাজাহ)।

রাসূলুল্লাহ (স) মালিকপক্ষের প্রতি সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘শ্রমিকরা তোমাদের ভাই, আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করেছেন। অতএব, আল্লাহ কারও ভাইকে তার অধীন করে দিলে সে যা খাবে, তাকে তা থেকে খাওয়াবে এবং সে যা পরিধান করবে—তাকে তা থেকে পরিধান করতে দিবে।

আর যে কাজ তার জন্য কষ্টকর ও সাধ্যাতীত, তা করার জন্য তাকে বাধ্য করবে না। আর সে কাজ যদি তার দ্বারাই সম্পন্ন করতে হয়, তবে সে তাকে অবশ্যই সাহায্য করবে।’ (বুখারি) সুতরাং মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক হতে হবে হৃদ্যতাপূর্ণ। ভালবাসা ও সহানুভূতির সম্পর্কের মাধ্যমে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব এই দেশ-জাতিকে। তাই আসুন, শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হই। মেহনতি মনুষের শ্রমের যথার্থ মূল্যায়ন করি। এবারে মে দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গতি; উন্নয়নের শপথ করি।’

(তথ্যসূত্র-ইন্টারনেট)

লেখক-মহিউদ্দিন রাব্বানি,

মানবাধিকার কর্মী ও শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রজন্মনিউজ২৪

এ সম্পর্কিত খবর

ভোট দিতে গিয়ে শুনলেন তিনি মারা গেছেন, নিরাশ হয়েই ফিরলেন বৃদ্ধা

ইরানে হামলার পর নাগরিকদের ইসরায়েল ছাড়তে বলল অস্ট্রেলিয়া

মুস্তাফিজকে কেন পুরো আইপিএল খেলতে দিচ্ছে না বাংলাদেশ

খিলগাঁওয়ে পরিত্যক্ত ঘরে যুবকের ঝুলন্ত মরদেহ, পুলিশের ধারণা হত্যা

ছাত্রলীগ নেতার পর একই নারীর সঙ্গে ইউপি চেয়ারম্যানের ভিডিও ভাইরাল

কণ্ঠের সুরক্ষায় ঝাল-তৈলাক্ত খাবার পরিহারের পরামর্শ

৩টি ড্রোন ধ্বংস করল ইরান, নিরাপদে আছে ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনা

আগামীকাল ফিটনেস পরীক্ষা, থাকছেন কি সাকিব?

ফরিদপুরে মন্দিরে আগুন, এলাকাবাসীর পিটুনিতে নিহত ২

ঈদের আমেজ কাটেনি বাজারে, ফাঁকা ঢাকাতেও দাপট গরু-খাসির

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ