ছাত্রদলের পরাজয় সাংগঠনিক দুর্বলতা

প্রকাশিত: ১৪ মার্চ, ২০১৯ ১১:৩৫:৩৪

ছাত্রদলের পরাজয় সাংগঠনিক দুর্বলতা

সাংগঠনিক দুর্বলতাসহ বেশ কয়েকটি কারণে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের পরাজয় বলে মনে করছেন অনেকে। এ নিয়ে অসন্তোষ বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও।

মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মতে, ছাত্র অধিকার সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে ছাত্রদল সক্রিয় ছিল না। আবার সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির প্রায় সবাই অছাত্র। গত দশ বছরে ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে না পারায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। এ ছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি, প্যানেল গঠনে জটিলতা ও যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া ভোটে অংশ নেয়ার ফলে ডাকসু নির্বাচনে অকল্পনীয় বিপর্যয় হয়েছে।

তবে ছাত্রদলের শীর্ষ নেতাদের দাবি- ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির কারণে তাদের প্রার্থীরা বিজয়ী হতে পারেননি। ছাত্রদলের ভিপি ও জিএস পদে যে ভোট পড়েছে তাতে এ সন্দেহের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। ভিপি পদে মাত্র ২৪৫ ভোট পড়েছে। তাহলে সংগঠনের নেতাকর্মীরা কি ভোট দেননি? সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজিব আহসান যুগান্তরকে বলেন, ‘এবারের ডাকসু নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপি হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এ ধরনের কলঙ্কময় ঘটনা এর আগে ঘটেনি। এটা শুধু ছাত্রদল নয়, ছাত্রলীগ বাদ দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী ও সব ছাত্র সংগঠনের উপলব্ধি। শিক্ষকসমাজ, বিগত দিনে যারা ডাকসু নেতৃত্ব দিয়েছেন- সবাই এ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।’ ছাত্রদলের সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে ছাত্রলীগের ভূমিকা যদি সাংগঠনিক হতো, তাহলে ছাত্রদলের সাংগঠনিক অবস্থা পাওয়া যেত। ছাত্রদল দুর্বল থাকলে তারা সেভাবেই নির্বাচনের আয়োজন করত।’

১৯৯০ সালের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের জেরে ডাকসুতে বড় বিজয় পেয়েছিল। কিন্তু সোমবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ছাত্রদল ডাকসুর ২৫টি পদের একটিতেও জয় পায়নি। এমনকি প্রার্থীদের মধ্যে সম্পাদকীয় একটি পদ ছাড়া কেউ হাজারের ওপরে ভোট পাননি। ১২টি সম্পাদকীয় পদের মাত্র একটিতে ছাত্রদলের প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পেরেছেন। কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া বিষয়ক সম্পাদক পদে প্রার্থী কানেতা ইয়া লাম-লাম ৭ হাজার ১১৯ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন।

ভিপি পদে এই সংগঠনের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান ২৪৫ ভোট পেয়ে পঞ্চম হয়েছেন। জিএস প্রার্থী আনিসুর রহমান খন্দকার ৪৬২ ভোট পেয়ে ষষ্ঠ হয়েছেন। আর এজিএস প্রার্থী খোরশেদ আলম সোহেল পেয়েছেন মাত্র ২৯৪ ভোট। এ ছাড়া ১৮টি হল সংসদের কোনো পদেও ছাত্রদল জয় পায়নি। প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও ছিল না। হল সংসদগুলোতে ২৩৪টি পদের বিপরীতে ছাত্রদলের প্রার্থী ছিলেন মাত্র ৫৪ জন।এ প্রসঙ্গে ছাত্রদল প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘কি রকম নির্বাচন হয়েছে, তা সবাই দেখেছেন।

১০ তারিখ রাতেই ব্যালট পেপারে সিল দেয়া হয়েছে ছাত্রলীগকে জেতানোর জন্য। সকালে ভোটের আগেই কুয়েত মৈত্রী হল থেকে সিল মারা ব্যালট উদ্ধার করা হয়েছে। অনেকে ভোটই দিতে পারেননি, সে জায়গায় ৯ হাজার ভোটের ব্যবধানে অনেকে জয়ী হয়েছেন। তাদের বিজয়ী দেখানো হয়েছে। কারচুপির মাধ্যমে পুরোপুরি নীলনকশার নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে।’ সংশ্লিষ্টরা জানান, তফসিল ঘোষণার পর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে ছাত্রদলে দ্বিধাবিভক্তি ছিল।

সুষ্ঠু ও অবাধ ভোট নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের অধিকাংশ নেতা নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিরোধিতা করেন। কেন্দ্রীয় একজন যুগ্ম সম্পাদক যুগান্তরকে বলেন, যারা ডাকসু নির্বাচনে যাওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন তারা ছিলেন অছাত্র ও বয়স্ক নেতা। যারা এবার ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেবেন তাদের মধ্যে থেকেই হয়তো ভবিষ্যতে ছাত্রদলের কমিটিতে শীর্ষ পদে নেয়া হবে- এমন আশঙ্কা থেকে তারা বিরোধিতা করেছিলেন।

এ নিয়ে ছাত্রদলের সিনিয়র-জুনিয়র নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বৈঠকও করেছিলেন। নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ছাত্রদল নেতাদের সঙ্গে ওই বৈঠকে ডাকসু নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ওই সময় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছাত্রদল নেতাদের বলেন, ‘দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো ধরনের কর্মকাণ্ড কেউ করতে চাইলে পদত্যাগ করে করতে হবে।’

ছাত্রদলের একাধিক শীর্ষ নেতা জানান, ডাকসু নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ার পর প্রার্থী নিয়ে জটিলতা শুরু হয়। বয়সসীমা বেঁধে দেয়ায় ছাত্রদলের বর্তমান কেন্দ্রীয় এবং ঢাবি কমিটির কোনো নেতা প্রার্থী হতে পারেননি। জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির ফল বিপর্যয়ের কারণে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের অনেক যোগ্য নেতা প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ দেখাননি। শেষ পর্যন্ত বিকল্প না থাকায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল শাখার সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমানকে ভিপি, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক আনিসুর রহমান খন্দকার অনিককে জিএস ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক খোরশেদ আলম সোহেলকে এজিএস প্রার্থী করে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করে সংগঠনটি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের একজন সহসভাপতি যুগান্তরকে বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে আমাদের প্রার্থীরা প্রচারের সময়ও তেমন পাননি। তারপর আবার প্রচারে সমন্বয়হীনতাও ছিল। হল পর্যায়ের নেতাকে ডাকসুর প্রার্থী করায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে তারা অপরিচিত ছিলেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্রদল প্রার্থীদের জয়ী করার ক্ষেত্রে সিনিয়র নেতাদের আন্তরিকতার অভাবও ছিল। কারণ, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩ হাজারের মতো অনাবাসিক ছাত্র ছিল।

তাদের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তাদের বাসায় গিয়ে অথবা ফোন করে যোগাযোগ করা যেত। কিন্তু এ ব্যাপারে কেউ আগ্রহই দেখাননি। অনাবাসিক ভোটারদের টার্গেট করা হলে ছাত্রদলের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয় পেত। যেখানে ডাকসুর ভিপি পদে ১১ হাজার ৬২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। ডাকসু নির্বাচন পরিচালনায় বিএনপি গঠিত কমিটির এক নেতা জানান, দেশে সুস্থ রাজনীতি না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী বিএনপি মনোভাবাপন্ন হলেও সরাসরি রাজনীতিতে আসতে চাইছেন না।

শিক্ষাজীবন শেষে সরকারি চাকরির সুবিধার জন্যই তারা এমনটা করছেন। আবাসিক হলের নেতাকর্মীরা হলে থাকার সুবিধার জন্য প্রকাশ্যে সমর্থন দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এ রকম জটিল পরিস্থিতিতে তাদের নির্বাচনে যেতে হয়েছে। ছাত্রদলের প্যানেল ঘোষণার জটিলতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে জয়লাভের জন্য নয়, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল ক্যাম্পাসে যেতে পারবে, রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারবে, নিজেদের অবস্থান জানান দিতে পারেবে- এই চিন্তা থেকে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেয়া।

ছাত্রদলের রাজনীতিতে প্রকাশ্যে কেউ অংশগ্রহণ করতে না পারলেও নীরব সমর্থক ভোট রয়েছে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে ছাত্রলীগের কার্যক্রমের ওপর বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রদল প্যানেলকে সমর্থন করবে- এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির বিরোধিতার পরও তারা নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে মত দেন।’ এদিকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রায় তিন বছর আগে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটিরও মেয়াদ শেষ হয়েছে এক বছর আগে।

অছাত্রদের দিয়ে বছরের পর বছর কমিটির মেয়াদ পার করার কারণে তাদের পূর্ণাঙ্গ প্যানেল গঠনে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে ছাত্রীদের হলগুলোতে তারা কোনো প্যানেলই দিতে পারেনি। অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ডাকসুতে ভোটই তো হয়নি। যেখানে ভোটই হয়নি, সেখানে কে কত ভোট পেয়েছে সেসব আলোচনা করে লাভ কি। সুষ্ঠু ভোট হলে ছাত্রদলই জিততো।

ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন বলেন, ছাত্রদলকে গত দশ বছরে ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে দেয়া হয়নি। ছাত্রলীগ একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার সহাবস্থানের ব্যাপারে দাবি জানানো হলেও কর্ণপাত করেনি। দশ বছরে ছাত্রদলের ক্যাম্পাসে অনুপস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা তো ডাকসু নির্বাচনে প্রভাব পড়েছে। ভোট কারচুপির মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে নির্বাচন করেছে তা নজিরবিহীন।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, ছাত্রদলের বেশিরভাগ নেতাকর্মীই হলে থাকার সুযোগ পায়নি, বাইরে ছিল। এ নির্বাচন উপলক্ষে তারা সাহস করে যে সব হলে প্রচার চালাবে তাও সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া নিয়মিত ছাত্রদের হাতে সংগঠনের নেতৃত্বে না থাকাটাও পরাজয়ের মূল কারণ। তিনি বলেন, সব দল-মতের ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়া করবে, বিভিন্ন হলে থাকবে।

এই অধিকার সবার আছে। এই পরিবেশটা যদি না পাওয়া যায় তাহলে কি করার আছে। আমি যখন উপাচার্য ছিলাম তখন ‘পরিবেশ পরিষদ’ করেছিলাম। সব সংগঠনের নেতাদের ৫ জন করে নিয়ে ‘পরিবেশ পরিষদের’ বৈঠক করা হতো। সেখানে সবার কথা বলার সুযোগ ছিল। নিজের মধ্যে সমস্যাগুলো সমাধান করার একটা প্রক্রিয়া ছিল। এখন তা নেই। এটা হলেও তো ক্যাম্পাসে সহাবস্থান থাকত।

প্রজন্মনিউজ২৪/তারেক আজিজ

 

 

 

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ