প্রতি বছরে দেশে প্রায় ছয় লাখ মানুষ দগ্ধ হয়

প্রকাশিত: ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯ ০৬:০৮:৩৭

প্রতি বছরে দেশে প্রায় ছয় লাখ মানুষ দগ্ধ হয়

 

দেশে বছরে ছয় লাখ মানুষ দগ্ধ হয়। পৃথিবীর আর কোথাও এত মানুষ দগ্ধ হয় না। পাশের দেশ ভারতেও এত মানুষ আগুনে দগ্ধ হয় না। গত দুই দশকে শুধু শিল্পকারখানাতেই ২৬টি বড় ধরনের দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। যার মধ্যে অধিকাংশই অগ্নিকাণ্ড।

এই তথ্য দিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও। দুর্ঘটনাগুলোতে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় দুই হাজার মানুষ। গত ২১ ফেব্রুয়ারি শোকের রাতে আবারো শোক নেমে আসে, চকবাজারে ৭০ জনেরও বেশি মানুষের প্রাণহানীর মাধ্যমে।

দেশে বছরে ছয় লাখ মানুষ দগ্ধ হয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘দেশে প্রতিদিনই বয়লার, গ্যাসলাইন বা গ্যাস সিলিন্ডারে বিস্ফোরণ ঘটে। দেখা যায়, বেশিরভাগ গ্যাসলাইন অবৈধ। এর প্রভাব সবসময়ই আমরা দেখতে পাচ্ছি।

প্রতিদিন মানুষ আগুনে হতাহত হচ্ছে।ব্যবসায়ীক কারণে সামান্য কয়টা টাকার লোভে মালিক নিজে তার শ্রমিককে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে পোড়া রোগী আসলে এবং বেশি বার্ন হলে কিছু করার থাকে না। তাই নিমতলীর ঘটনাতেও বলেছি, এখনো সবাইকে সচেতন হবার জন্য বলি সচেতন না হলে এ ধরনের ভয়াবহ আগুন থেকে আমরা কোনোদিন মুক্তি পাব না।

ঢাকা শহরে এমনিতেই জনসংখ্যা বেশি, পুরান ঢাকার দিকে খুবই ঘনবসতি। পুরান ঢাকার রাস্তাঘাট খুবই অপ্রশস্ত যার ফলে কোনো ধরনের অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারে না। এর ফলে মুহূর্তের মধ্যে ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং প্রাণহানি বাড়ে।

গত দুই দশকের দুর্ঘটনাগুলোর একটি পরিসংখ্যানের চিত্র এ রকম ১৯৯০ সালে ১৭ ডিসেম্বর সারেকা গার্মেন্টসে মারা গেল ২৭ জন, ১৯৯৫ সালে ইব্রাহীমপুরে লুসাকা অ্যাপারেলে মারা গেল ১০ জন, ১৯৯৬ সালে ঢাকার তাহিদুল ফ্যাশনে ১৪ জন, একই বছর সানটেক্স লিমিটেড কারখানায় ১৪ জন, ১৯৯৭ সালে মিরপুরের রহমান অ্যান্ড রহমান অ্যাপারেলসে ২২ জন, ২০০০ সালে বনানীর গ্লোব নিটিংয়ে ১২ জন, ২০০১ সালে মিরপুরে মিকো সোয়েটারে ২৪ জন, ২০০৪ সালে মিসকো সুপারমার্কেট কমপ্লেক্সে ৯ জন, ২০১৬ সালে টঙ্গীতে ৩৫ জনের মৃত্যু হয়।

এই খণ্ড চিত্রগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে স্থানীয় পরিবেশই এই মৃত্যুর অন্যতম কারণ। তখন থেকে জোরালো দাবি ওঠে গার্মেন্টস কারখানাগুলো রাজধানী থেকে দূরে সরানোর। গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ড এবং দুর্ঘটনা রোধে অনেকটা কাজ হয়েছে, এমনটা বলা যায়।

গত কয়েক বছরে গার্মেন্টস কারখানায় দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেক কমে গেছে, শুধু ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা থেকে এগুলো সরিয়ে নেয়ার কারণে।এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের নিমতলী ট্র্যাজেডির পর দ্রুত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য হয়েছে। শুধু তাই নয় পুরান ঢাকার বাসা-বাড়ি থেকে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম ও কারখানাগুলো নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার জন্য হাইকোর্টও নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিছুই কাজ হয়নি।

প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রী এবং হাইকোর্টের নির্দেশকেও অমান্য করার ক্ষমতা রাখেন কীভাবে?’তিনি বলেন, ‘কোথাও শিল্পকারখানা করতে হলে, শুধু ট্রেড লাইসেন্সই যথেষ্ট নয়। পরিবেশ অধিদফতরসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সংস্থার অনুমোদন নিতে হয়।

ট্রেড লাইসেন্স করতে গেলে আশপাশের বসতবাড়ির মালিকদেরও সম্মতি নিতে হয়। কেউ যদি সরল মনে এবং স্বাভাবিক পথে ট্রেড লাইসেন্স করতে যায়, তাহলে তাকে হাজারও ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়। কিন্তু অবৈধ কারখানা এবং মৃত্যু ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক দ্রব্য বেচাকেনা এবং গুদামজাতকরণ সবই চলে পুরনো ঢাকার মতো ঘিঞ্জি পরিবেশে।

আর সেটা চলে আসছে সব বাধা অতিক্রম করে।’পুরনো ঢাকায় রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবসা বন্ধে ২০১৩ সাল থেকে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন বন্ধ করে দিয়েছিল সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু ব্যবসা বন্ধ হয়নি। সিটি কর্পোরেশনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে লাইসেন্স ছাড়াই চলতে থাকে ব্যবসা।

এখানেই থেমে থাকেননি তারা। ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া ব্যাংক ঋণ পাওয়া যায় না বলে ব্যবসায়ীরা চাপ দিতে থাকে সিটি কর্পোরেশনকে। সেই চাপে চকবাজার দুর্ঘটনার মাত্র দু’দিন আগে পরিদর্শন করতে গিয়ে পাঁচটি রাসায়নিক প্রতিষ্ঠানকে তাৎক্ষণিক লাইসেন্স নবায়ন করে দেয় সিটি কর্পোরেশন।

গবেষক অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলেন, ‘পৃথিবীর দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ শহর হিসেবে এই পুরান ঢাকার এমন জায়গা আছে যেখানে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি কিংবা অ্যাম্বুলেন্স কেন- লাশের খাটিয়া বহন করে নিয়ে যাওয়ার মতো পথও নেই।

আর কয়েক ফুটের সেই পথের দুইপাশে আছে বহুতল ভবনের ছড়াছড়ি।’ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ৮৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নাসির আহমেদ বলেন, ‘রাসায়নিকদ্রব্যের দোকান কিংবা গুদাম সরিয়ে নেয়ার পরেও ওইসব এলাকার মানুষের নিরাপদ জীবনযাপনের জন্য নতুন করে ভাবতে হবে।

সময় এসেছে- পুরনো ঢাকার রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের। ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সততা ও আন্তরিকতার বিষয়টির পাশাপাশি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও দরকার। এই মুহূর্তে স্থানীয় মানুষের মধ্যে চকবাজার ট্র্যাজেডির আবেগ কাজ করছে। এই আবেগকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিবে বলে আমার বিশ্বাস করি।

’নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডার (অব.) ইসফাক এলাহী চৌধুরী বলেন, ‘সরকারের উচিত হবে চকবাজারের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে রাসায়নিক পদার্থের জন্য নীতিমালা গ্রহণ করা এবং এর বাস্তবায়নে জোর দেয়া। কেউ যদি নীতিমালা না মানে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’

প্রজন্মনিউজ২৪/মামুন

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ