প্রায়শ্চিত্ত

প্রকাশিত: ২৫ অক্টোবর, ২০১৮ ০১:৩৬:৩৬

প্রায়শ্চিত্ত

 প্রায়শ্চিত্ত

লেখক:রাজু আহম্মেদ

:- হ্যালো রাজু, কেমন আছিস?

বারো বছর পর এই কন্ঠটা আমি শুনলাম। এক সেকেন্ডের বেশি সময় লাগেনি ওকে চিনতে আমার। আমার বন্ধু মিথুন। সেই উলঙ্গপনা থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত আমরা একসাথে লেখাপড়া করেছি।

তখন বেস্টফ্রেন্ড নামক কোনো বিশেষণের উদয় হয়নি। আমরা ছিলাম বন্ধু, একসাথে স্কুলে যাওয়া-আসার বন্ধু। একই বেঞ্চে পাশাপাশি রোজ বসার বন্ধু। ক্লাসে একই অপরাধে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার বন্ধু। ভরদুপুরে অন্যের গাছের আম-বড়ই-জলপাই-জাম ও কাঠাল চুরির বন্ধু।

আমি:- কে, মিথুন? তুই কেমন আছিস?

:- এসে বলি? আমি আগামীকাল আসছি। তুই ষ্টেশানে থাকিস কিন্তু, রাস্তাঘাট ভুলেও যেতে পারি!

:- অবশ্যই থাকবো দুস্ত, তুই সাবধানে আসিস!

আমার এতো খুশি লাগছে যে বর্তমান কে স্বপ্ন মনে হচ্ছে। সেসব মুহুর্তগুলো খুব বেশি মনে পরছে যখন ও ছিলনা আর আমি ভাবতাম আজ মিথুন থাকলে কেমন হতো! আজ মিথুন থাকলে আমরা একসাথে এটা করতাম সেটা করতাম ইত্যাদি।

ভোর ছ'টায় ট্রেন আসবে, আমি ও ট্রেন উভয়ই যথাসময়ে উপস্থিত। কম্পাটমেন্ট ভর্তি মানুষজন, কেও উঠছে কেউ নামছে। কেউ আবার কাউকে খোঁজছে।

পেছন থেকে মিথুন আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বিদেশি পারফিউম এর ঝাঁজ এর ফাঁকেও পরিচিত একটা গন্ধে আমার ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে যায়। অনেক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখলাম মিথুনকে।

মিথুন:- "কিরে মাষ্টার, তুই তো দেখি বুড়া হয়ে গিয়েছিস। আমাকে দেখ, আমি একটুও বদলাই নি।"

আসলেই মিথুন সেই আগের মতোই আছে। আমি ওর পেটে আস্তে করে একটা ঘুষি দিয়ে বললাম ;- "চল বাসায় চল।"

:-না, তুই এক কাজ কর,ব্যাগটা বাসায় পৌছানোর ব্যবস্থা কর। তোকে নিয়ে আমি আগে এলাকাটা ঘুরে দেখবো। স্মৃতিতে অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া পরিচিত জায়গাগুলো খুব করে টানছে আমাকে।

:- আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে চল আমাদের স্কুলটাই আগে দেখে আসি।

:- স্কুল তো দেখাই যাবে, হেডমাষ্টার সাহেব তো সাথেই আছে। (বলে নিই, আমি আমাদের স্কুলের বর্তমান হেডমাষ্টার):- প্রথমে কোথায় যাবি বল।

:- (মিথুন নরম স্বরে বললো) তুই বুঝতে পারছিস না আমি কোথায় যেতে চাচ্ছি?

আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি মিথুন কোথায় যেতে চাচ্ছে। ও তার প্রথম প্রেমের সাক্ষ্য বহনকারী সবকিছু দেখতে যেতে চাচ্ছে।

মিনুদের বাড়ির পাশের দুতলা বিল্ডিং এর ছাদ, বাড়ির পেছনে খালের পাড়ে প্রাচীন জীর্ণশীর্ণ বাঁধানো ঘাট, মিনুদের বাড়ি হতে স্কুলে আসার রাস্তাটা ইত্যাদি। তবুও না বোঝার ভান করে বললাম:- অনেকদিন হয়ে গেছে তো, তাই হয়তো তোকে খুব ভালো পড়তে পারছিনা।

মিথুন:- চল মিনুদের বাড়ির এদিকে ঘুরে আসি!

আমরা হাটছি স্কুল থেকে মিনুদের বাড়ির দিকে যাওয়া রাস্তা ধরে। রাস্তাটা আর কাঁচা নেই, জমি থেকে ছয় ফুট উচুঁ এবং বারো ফুট প্রশস্ত পিচ ঢালা পরিষ্কার পথ। মিথুন নিচের দিকে তাকিয়েই হাটছে ও কথা বলছে। মনে হচ্ছে মিনুর প্রতিটা পায়ের ছাপ কল্পনা করে সে গভীরভাবে অনুভব করছে।

মিথুন:- "তোর মনে আছে রাজু? আমি আর মিনু পাশাপাশি হাঁটতাম আর তুই ভয়ে আমাদের থেকে ১০০ হাত দূরে দূরে হাঁটতি। আর স্কুলে গিয়ে জিজ্ঞেস করতি 'আমি এত কী কথা বলি ওর সাথে'।

একদিন কী হয়েছিল জানিস? আমি সত্যি সত্যিই কোনো কথা খোঁজে পাচ্ছিলাম না বলার। ওর পাশাপাশি হাটছি আর মুখে বিড়বিড় করে বলছি "আই লাভ ইউ - আই লাভ ইউ - আই লাভ ইউ"।

স্কুলের গেটে পৌছে যাবার সময় ও বলেছিলো "মাত্র সাত'শ একষট্টি বার?" আমি সেদিন তার প্রতি এতটা মুগ্ধ হয়েছিলাম যে ও ক্লাসে ঢুকার পরও আমি রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম অনেকক্ষণ।

আমি:- ঘাটলার এদিকে যাবিনা মিথুন? (মিথুন কেমন করে যেন আমার দিকে তাকালো, কারন ঐ ঘাটলার কোনো কথা আমার জানার কথা না)

মিথুন:- হ্যাঁ চল। আচ্ছা রাজু, এই ঘাটলায় মিনুর সাথে যে আমার শেষ দেখা ও কথা হয়, তোকে আমি বলেছিলাম?

:- মনে নেই, বলেছিলি হয়তো।

:- সেদিন সন্ধায় আমার চলে যাবার কথা শুনে মিনু কাঁদতে কাঁদতে তার জামা ভিজিয়ে ফেলেছিল। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ও তার কান্নার শব্দ দমাতে চেষ্টা করে যাচ্ছিল কিন্তু হেচকি দিয়ে দিয়ে যে করুন ধ্বনি আমার কানে আসছিল, সেটা তখন আমার বিরক্তির কারনই মনে হয়েছিল। কিন্তু অনেক পরে আমার বুঝে আসে আমি কাকে হারিয়েছি। আমার অপরাধবোধের কারনে আজ তোকে জিজ্ঞেস করতেও সাহস হচ্ছেনা মিনু কোথায় আছে, কেমন আছে।(মিথুনের চোখে পানি)

:- তুই শান্ত হো মিথুন, মিনু বেশ ভালোই আছে। আচ্ছা, তুই মিনুর সাথে এমন কেন করেছিলি? মেয়েটাকে এতটা কষ্ট তুইবকেন দিয়েছিলি?  তুই জানিস, মিনু মেয়েটা কতটা কষ্ট পেয়েছিলো? মানুষিক চিকিৎসা করাতে হয়েছিলো তাকে। তুই তো পারতি সবকিছু গুছাতে! একটা ভালো সুখের গল্প হতো তোদের জীবনটা!

:- বাবার ট্রান্সফারের পর ঢাকা গিয়ে নতুন বন্ধু-বান্ধবী পাই। ইউনিভার্সিটিতে এডমিশনের পর কেন যেন মিনুকে অনেক নগণ্য মনে হচ্ছিলো। আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম ও আমার যোগ্য নয়, আমি ওর চেয়ে আরো ভালো কোনো মেয়ে ডিজার্ভ করি। আমার অহমিকা আমার চোখে একটা মিথ্যা পর্দা ফেলে দেয়, যার ফলে ওকে আমি এড়িয়ে যাই।

আমি:- চল বাসায় চল, দুপুর হয়ে গেল। তোর ভাবি অপেক্ষা করছে।

আমি মিথুনের কাঁধে হাত রেখে ছোট্টবেলার স্কুলে যাওয়ার মতো করে হাটছি বাড়ির দিকে।বাসায় গিয়ে কলিংবেল না চেপে আমি আমার বউকে খুব আদর মাখা কন্ঠে ডাকতে লাগলাম।

:- মিনু,,,,,দরজা খোলো মেহমান আসছে। মিনু,,,মিনু,,,। (আমি মিথুনে'র দিকে আর তাকাচ্ছিনা,ওর বিভৎস চেহারা দেখার ইচ্ছে আমার নেই)

মিনু দরজা খুললো। আমাদের ছেলেটাও এসে দাড়ালো মিনুর পাশে।

মিনুর দিকে তাকিয়ে মিথুন বুঝতে পারলো মিনু সুখেই আছে। স্বামী সন্তান আর ঘরভরা ভালোবাসা নিয়ে মিনু আজ মিথুনের সামনে দাঁড়িয়েও হাসতে পারছে।

কিন্তু মধুর অতীতের ভয়ংকর সমাপ্তির প্রায়শ্চিত্ত স্বরুপ মিথুনের চোখে আজ পানি।

প্রজন্মনিউজ২৪/জামান

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ