ব্লাকমেইলিং এ্যাপস্ ’বিগো ’লাইভ’

প্রকাশিত: ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০৩:০৪:০৬

ব্লাকমেইলিং এ্যাপস্ ’বিগো ’লাইভ’

কথিত মনোরঞ্জনে জনপ্রিয়তা বেড়েছে বিগো লাইভের ব্লাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ সামাজিক ভাবমূতির্ রক্ষায় আইনের আশ্রয় নেন না। আক্রান্তরাটাগের্ট বিবাহিত পুরুষ দেশে তরুণ সমাজের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বিগো লাইভ নামে নতুন অ্যাপস তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে মানুষ যেন যন্ত্রনিভর্র হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে স্মাটের্ফানে মনোরঞ্জনের জন্য বিভিন্নজন নানা ধরনের অ্যাপস, সফটওয়্যার ও মেকানিজম ব্যবহার করছেন। সব বয়সী মানুষ যেমন এসব মেকানিজমে আকৃষ্ট হচ্ছেন তেমনি মাত্রাতিরিক্ত আকষর্ণই নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে সমাজকে। বিশেষ করে তরুণদের।

 

বতর্মান বিশ্বে বেশকিছু জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ও অ্যাপস রয়েছে। দেশে জনপ্রিয় ২০টি ওয়েবসাইটের মধ্যে তিনটি হলো পনোর্ (অশ্লীল) সাইট। সরকার কয়েক দফা এই সাইটগুলো বন্ধের চেষ্টা করে। কিন্তু কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর নিজস্ব আইটি বিশেষজ্ঞ দিয়ে সেগুলো ফের সচল করা হয়।

 

সারাবিশ্বে জনপ্রিয় অ্যাপসগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, ফেসবুক লাইট ও স্ন্যাপচ্যাট। এগুলোর মাধ্যমে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এসব অ্যাপসের মাধ্যমে ছবি, ভিডিও, স্টিকার, অডিও ফাইল, ভয়েস ও ভিডিও কল আদান-প্রদান করা যায়।

 

বাংলাদেশে ব্যবহৃত অ্যাপসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফেসবুক। তবে ‘বিগো লাইভ’ নামে নতুন একটি অ্যাপস দেশের তরুণ সমাজের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পৃথিবীর সবর্বৃহৎ লাইভ স্ট্রিমিং কমিউনিটি এ অ্যাপসটি বতর্মানে তরুণ-তরুণীদের পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্ক, বিবাহিত, এমনকি প্রবাসীরাও বেশ ব্যবহার করছেন। দিন দিন জনপ্রিয়তা বাড়ায় দাম্পত্য জীবনে সুখী নন, বিশেষ করে স্ত্রী-সন্তান রেখে দীঘির্দন বাইরে থাকা প্রবাসীদের টাগের্ট করে এক শ্রেণির অসাধু চক্র \এর মাধ্যমে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছেন। কথিত মনোরঞ্জনের নামে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

 

অ্যাপসটি পযের্বক্ষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে পঁাচশ বিবাহিত-অবিবাহিত তরুণী, মধ্যবয়স্ক নারী এবং তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের অ্যাকাউন্ট রয়েছে। সেখান থেকে লাইভে গিয়ে অনলাইনে থাকা সঙ্গীদের সঙ্গে সরাসরি ভয়েস ও ভিডিও চ্যাটে তারা কথা বলেন। তাদের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের পর প্রাইভেট রুমে ডেকে দাবি করা হয় অথর্।

 

অ্যাপসটির কমপক্ষে ১০০টি চ্যাটরুমের চ্যাট পযের্বক্ষণে দেখা গেছে, অধিকাংশ তরুণী, বিশেষ করে মধ্যবয়সী নারী প্রাইভেটভাবে চ্যাট করার জন্য প্রবাসী ও বিবাহিত পুরুষদের নিমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। প্রতিটি চ্যাটরুমেই বিভিন্ন বয়সী পুরুষরা অবাধে তাদের সঙ্গে কথা বলছেন।

 

সমাজবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাম্পত্য জীবনে হতাশা আর অশান্তিতে থাকা পুরুষদের ফঁাদে ফেলেই সবর্নাশ ঘটাচ্ছে বিগো লাইভ। দীঘির্দন স্ত্রী থেকে বিচ্ছিন্নের কারণে প্রবাসী শ্রমিকদের টাগের্ট করেও জনপ্রিয় করে তোলা হচ্ছে অ্যাপসটি।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনাকে আমরা বলি অনলাইন ভিকটিমাইজেশন। এখানে একজন তরুণী বা নারী যেভাবে অন্যের সঙ্গে কথা বলেন তা আমাদের সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে কোনোভাবেই যায় না। এসব সাইট ও অ্যাপস চলতে থাকলে যুবসমাজের সামাজিক পরিচ্ছন্নতা ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ব্যাহত হবে। ফলাফল হিসেবে সামাজিক সম্মানহানির ঘটনা ঘটবে। ধষর্ণ, ইভ টিজিং বাড়বে।’

 

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ) এক জরিপে উঠে এসেছে, ৩০ থেকে ৪৫ বছর বয়সের শতকরা ১২ দশমিক ৭৭ জন সাইবার অপরাধে বেশি আক্রান্ত হন। আক্রান্তদের মধ্যে ১৭ শতাংশ সামাজিক ভাবমূতির্ রক্ষার জন্য আইনের আশ্রয় নেন না। তবে বিগো লাইভের শিকার মধ্য বয়সী আর প্রবাসীরা কেন? জানতে চাইলে সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, দেশে ঘণ্টায় একটি তালাক হচ্ছে। এর মানে পরিবারগুলোতে এক ধরনের ফ্রাসটেশন ও বোঝাপড়ার অভাব আছে। এ কারণে দম্পতিদের মধ্যে একটা গ্যাপ তৈরি হয়। গ্যাপ হলেই পাটর্নাররা (দম্পতি) অন্য অ্যাঙ্গেলে সাচর্ করা শুরু করেন। তখন তারা এসব অ্যাপস বা সাইটে নক করেন।’

 

‘এছাড়া বিবাহিত ও বয়স্ক লোকজনকে কনভিন্স করা খুবই সহজ। এসব অ্যাপসে টাকার বিনিময়ে কথা ও ভিডিও চ্যাট করা যায়। অধিকাংশ তরুণ ও শিক্ষাথীের্দর কাছে টাকা থাকে না। কিন্তু বয়স্কদের আথির্ক কোনো সমস্যা থাকে না, সে তখন সঙ্গী খেঁাজে। উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে, যদি এটা আরও ছড়িয়ে পড়ে তখন আরও বেশি সামাজিক অবক্ষয় দেখা দেবে।’

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত¡ বিভাগের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বলেন, ‘এই লাইভের কারণে সামাজিক সংকট তৈরি হতে পারে। বø্যাকমেইলিংয়ের ঘটনা ঘটতে পারে। কোনো ব্যক্তি যদি প্রাইভেট চ্যাটের জন্য কাউকে টাকা পাঠান, তিনি যদি ওই ব্যক্তির পরিবার কিংবা কমর্স্থলে এসব ফঁাস করে দেন তাহলে সামাজিকভাবে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। তার চাকরি চলে যেতে পারে, স্ত্রীও চলে যেতে পারে। সরকারের আইসিটি বিভাগের এ বিষয়ে নজরদারি থাকা উচিত।’

 

বিগোর ভয়াল থাবা থেকে তরুণ-তরুণী ও মধ্য বয়সীদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার উপায় জানতে চাইলে তৌহিদুল হক বলেন, ‘বাসায় বাবা-মা’র সময় না দেয়ায় একটা প্রভাব এখানে আছে। যেসব পরিবারে বাবা-মা উভয়ই চাকরিজীবী সে পরিবারে এগুলোর প্রভাব বেশি দেখা যায়। পাশাপাশি পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি বোঝাপড়ার ঘাটতি থাকে, ফ্যামিলি টেনশন থাকে- এসব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা না করলে পাটর্নার অন্য সুযোগগুলো সাচর্ করবেই। আমাদের সবার উচিত সংসার জীবনে আবদ্ধ হওয়ার পর পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে পরিবারের সিদ্ধান্তগুলো নেয়া।’

 

সাইবার বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, ‘এ ধরনের অ্যাপস ও ওয়েবসাইট ব্যবহারে প্রতারণা, বø্যাকমেইল করে টাকা হাতিয়ে নেয়া এবং অপহরণের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। এর প্রতিকার হিসেবে অনলাইনে ডেটিং বন্ধ করতে হবে। এছাড়া অনলাইনে পরিচয় হওয়া কারও সঙ্গে দেখা না করাই ভালো। দেখা করলে পাবলিক প্লেসে করতে হবে।’

 

যে কারণে বিগো লাইভের জনপ্রিয়তা বাংলাদেশে। বাংলাদেশে ট্রেন্ডিং (সম্প্রতি জনপ্রিয়তার শীষের্) অ্যাপসগুলোর মধ্যে লুডো স্টার, আলিএক্সপ্রেস, টেম্পল রান-২, লুডু কিং, সাবওয়ে সাফার্র, ফিফা ফ্রি কিক উল্লেখযোগ্য। এই গেমগুলোর মাঝে ৩০ সেকেন্ডের জন্য বিগো লাইভের বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। বিজ্ঞাপনগুলো দেখলে গেমে অতিরিক্ত কয়েন পাওয়া যায়। এ কারণে অনেকে না চাইলেও বিজ্ঞাপনগুলো দেখতে বাধ্য হন। এই বিজ্ঞাপনে ভুলেও যদি কারও চাপ পড়ে তখনই তা ডাউনলোড হয়ে যাবে। এছাড়া বাংলাদেশের কয়েকটি ওয়েবসাইট বিগো লাইভ থেকে অনৈতিকভাবে অথর্ উপাজের্নর নানা কৌশল জানিয়ে দিচ্ছে। এ কারণে হতাশা ও পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা থেকে অনেকেই বিগোতে আগ্রহী হচ্ছেন।

 

বিটিআরসির সিনিয়র সহকারী পরিচালক জাকির হোসেন খান বলেন, ‘এ ধরনের অ্যাপসে আমাদের নজরদারি রয়েছে। এমন অ্যাপস পেলেই আমরা তা খতিয়ে দেখি।’পুলিশের সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ দমন বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘কেউ যাতে এসব অ্যাপস ও ওয়েবসাইট ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে পুলিশের নজরদারি রয়েছে।’

প্রজন্মনিউজ২৪/নাজমুল

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ