বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির তীব্র সমালোচনা

প্রকাশিত: ২২ এপ্রিল, ২০১৮ ১১:৩০:০৯

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির তীব্র সমালোচনা

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির তীব্র সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে যেসব খাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। ২০১৭ সালের ওপর প্রণীত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সবচেয়ে গুরুত্বর যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে তার মধ্যে রয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, খেয়াল-খুশিমতো ও বৈআইনিভাবে আটকে রাখা, নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে জোর করে গুম করা, নাগরিক স্বাধীনতা সীমাবদ্ধতা। রয়েছে সংবাদমাধ্যম, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় সীমাবদ্ধতা। দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় আপস করা হয়েছে। সীমাবদ্ধতা রয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে।রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের স্বাধীনতা নেই। রয়েছে দুর্নীতি, সহিংসতা, লিঙ্গগত বৈষম্য, যৌনতা বিষয়ক অপরাধ, ধর্মীয় বিষয়। আর রয়েছে জবাবদিহির অভাব। এখনও মানবপাচার একটি গুরুত্বর সমস্যা হয়ে আছে। রয়েছে শ্রমিকদের অধিকারের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা। শিশুশ্রমের অবস্থা একেবারে বাজে।

 

    এ ছাড়া রয়েছে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে নির্যাতনের অভিযোগ থেকে তাদের দায়মুক্তি দেয়ার ব্যাপকতা। নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা যেসব নির্যাতন বা হত্যাকাণ্ড ঘটায় তা তদন্তে বা বিচার প্রক্রিয়ায় সরকার সীমিত পদক্ষেপ নিয়েছে। পুলিশ ও নিরাপত্তামূলক সেবাখাতগুলোতে জনগণের রয়েছে অনাস্থা। এজন্য তারা ফৌজদারি কোনো ঘটনা রিপোর্ট করতে বা সরকারি বাহিনীর সহায়তা নেয়া থেকে বিরত থাকেন। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধানে জনগণের জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার দিয়েছে। কিন্তু অসংখ্য রিপোর্টে বলা হচ্ছে, সরকার অথবা তার এজেন্টরা খেয়াল-খুশিমতো অথবা বেআইনিভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে। ঘেরাও, গ্রেপ্তার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অন্যান্য অপারেশন চালানোর সময় ঘটছে সন্দেহজনক মৃত্যু।

    

     নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা ঘন ঘন বলে থাকেন, তারা শেষ রাতের দিকে সন্দেহজনক অপরাধীকে সঙ্গে নিয়ে অপরাধ সংঘটনের স্থান বা আস্তানার খোঁজে অপারেশন চালাতে বের হন। উদ্দেশ্য থাকে অস্ত্র উদ্ধার বা ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করা। বলা হয়, যখন ওই সন্দেহভাজন অপরাধীর সহযোগীরা পুলিশের দিকে গুলি ছোড়ে তখন সন্দেহভাজন ব্যক্তি নিহত হন। সরকার যথারীতি এটাকে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যাকাণ্ড, গানফাইট বা এনকাউন্টারে হত্যা বলে দাবি করে। র‌্যাব ও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সঙ্গে অপরাধীদের গোলাগুলিকে এভাবেই বর্ণনা করা হয়। তবে মিডিয়া মাঝে মাঝেই এটাকে পুলিশের বৈধতা দেয়া বলে বর্ণনা করে। মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন ও মিডিয়াগুলো এমন সব ক্রসফায়ারের অনেকগুলোকে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে আখ্যায়িত করে।

    

    কোনো কোনো আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে ১৬২ জনকে। আরেকটি মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অধিকারের হিসাবে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা ২০১৭ সালের প্রথম ১০ মাসে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করেছে ১১৮ জনকে। ১২ই মে র‌্যাব গুলি করে হত্যা করে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার রকিবুল হাসান বাপ্পি ও লালন মোল্লাকে। র‌্যাবের দাবি, নিষিদ্ধ ঘোষিত পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির একটি বৈঠকে ঘেরাও চালায় তারা। এ সময় বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় ওই দুজন। কিন্তু নিহতদের পরিবারের সদস্যদের দাবি, তাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা গ্রেপ্তার করে কয়েক মাস আগে। ফলে এই এনকাউন্টার নিয়ে যে বিতর্ক তা রয়েই গেছে। শুক্রবার এ রিপোর্ট প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন জে সুলিভান। ওই রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধান সংবাদমাধ্যম সং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে।

  

    কিন্তু এই অধিকারের প্রতি মাছে মাঝেই সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। সংবিধানে সংবিধানের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহের সমান করে দেখানো হয়েছে। এমন রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে কেউ অভিযুক্ত হলে তাকে তিন বছর থেকে যাবজ্জীবন সাজা পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। ২০১৬ সালে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব মাহমুদুর রহমান মান্না ও সাংবাদিক কনক সারওয়ারসহ উচ্চপর্যায়ের অনেক ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে মান্না ও কনক সারোয়ারের বিচারপ্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয়নি সরকার। ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ে এমন বক্তব্যকে সীমাবদ্ধ করেছে আইন। কিন্তু ঘৃণামূলক বক্তব্যের সংজ্ঞা কি তা পরিষ্কার করে বর্ণনা করা হয়নি। এর ফলে হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে সরকার বড় শক্তি ব্যবহার করার সুযোগ পায়।

  

     রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে যায়, বিদেশি বন্ধুপ্রতীম দেশের বিরুদ্ধে যায়, আইনশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে যায়, নৈতিকতার বিরুদ্ধে যায়, আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে, মানহানি হয় অথবা অপরাধকে উসকে দেয় এমন সব বক্তব্য সীমিত করতে পারে সরকার। বাংলাদেশে প্রিন্ট ও অনলাইন নিরপেক্ষ মিডিয়া সক্রিয় রয়েছে। তারা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। যেসব মিডিয়া সরকারের সমালোচনা করেছে তারা সরকারের নেতিবাচক চাপের মুখে পড়েছে। মাঝে মাঝে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোসহ কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন করে। এতে গত অক্টোবরে একটি অনলাইন নিউজ আউটলেটের একজন সাংবাদিক উৎপল দাসের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। বলা হয়, অক্টোবরে উৎপল নিখোঁজ হলেও ডিসেম্বরে তাকে ফিরে পাওয়া যায়। তার পর উৎপল দাস যে বক্তব্য দিয়েছেন তার ফিরে আসা নিয়ে তাতে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে।

 

    তবে পর্যবেক্ষকদের অভিযোগ ভীতি প্রদর্শনের পদ্ধতি অনুসরণ করে তাকে জোর করে গুম করা হয়েছিল। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর ও সামাজিক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মুবাশ্বের হাসান গত বছর ৪৪ দিন নিখোঁজ ছিলেন। দ্য ওয়্যার নামে একটি সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট অভিযোগ করে যে, একটি বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা এই নিখোঁজের জন্য দায়ী। এর ফলে ওই ওয়েবসাইটটি ব্লক করে দেয় সরকার। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের মতে, ১৭ই মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিদেশের দূতবাসগুলোতে চিঠি পাঠানো হয়। বাংলাদেশি কোন সাংবাদিক বিদেশ সফরে গেলে তাদের ওপর নজরদারি করতে নির্দেশনা দেয়া হয় ওই চিঠিতে। এতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের নিরপেক্ষতা নিয়ে সাংবাদিকরা অভিযোগ করেছেন, সরকারি গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞাপন অর্থনীতিকে নিজেদের হাতের মুঠোয় রেখে মিডিয়ার ওপর প্রভাব বিস্তার করছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

 

    তারা একইভাবে বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে তাদের  বিজ্ঞাপন না দিতে বা ধরে রাখতে চাপ প্রয়োগ করেছে। বেসরকারি মালিকানাধীন সংবাদপত্রগুলো সাধারণত বিভিন্ন রকম মতপ্রকাশের স্বাধীনতা উপভোগ করে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক মেরুকরণ ও সেলফ সেন্সরশিপ একটি বড় সমস্যা রয়ে গেছে। বিজ্ঞাপনী খরচ নিজেরা হাতের মুঠোয় ধরে রেখে বিজ্ঞাপনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে সরকার। সরকারের সমালোচনা করলে মিডিয়াকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। বহুবার সরকারি কর্মকর্তারা বিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বিবৃতি প্রচার না করার কারণে বেসরকারি মালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে হুমকি দিয়েছেন। প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনামূলক রিপোর্ট প্রকাশ করে। এজন্য তাদের প্রধানমন্ত্রীর ইভেন্টগুলোতে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয় না।এটা পর্যবেক্ষকদের অভিমত।

 

    ক্ষমতাসীন দলের ক্ষতি হচ্ছে কোনো রিপোর্টে -এমনটা মনে করলেই সরকার তাতে হস্তক্ষেপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই রিপোর্টে আরো বলা হয়, ২২শে সেপ্টেম্বর মিয়ামনারের সংবাদভিত্তিক পোর্টাল মিজিমা ডট কমের একটি রিপোর্টের উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, ওই রিপোর্টটি ২৩শে সেপ্টেম্বর স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেল যমুনা টিভি ও ডিবিসি নিউজ প্রচার করে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে। কিন্তু তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয় ওই রিপোর্ট প্রত্যাহার করতে। এতে বলা হয়, ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব ও জটিলতার শিকার হচ্ছেন বলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অনেক সাংবাদিকের অভিযোগ। বড় সব সংবাদমাধ্যমসহ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা প্রবেশের ঢল নিয়ে রিপোর্ট করার সুযোগ পায়। কিন্তু সেপ্টম্বরে মিয়ানমারের দুজন সাংবাদিককে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে আটক করা হয়।

 

      আন্তর্জাতিক অনেক মিডিয়ার সাংবাদিক টুরিস্ট ভিসার অধীনে বাংলাদেশ সফর করেন। কিন্তু একই রকম ভিসা ব্যবহার করে বাংলাদেশে প্রবেশের কারণে পুলিশ ওই দুজন সাংবাদিক কেই আটক করে। দুই সপ্তাহ তাদেরকে আটকে রাখার পর মুক্তি দেয়া হয়। তবে তাদের দেশ ছাড়তে বারণ করা হয়। এর চার সপ্তাহ পরে কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করে। ওই রিপোর্টে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বর্ণনা উল্লেখ করে বলা হয়, ২০১৭ সালে নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা ৫৩ জনকে হত্যা করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। অন্যদিকে অধিকার বলছে, বছরের প্রথম ছয় মাসে ৬ বন্দিকে হত্যা করেছে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। নওগাঁ জেলার স্থানীয় এক নেতা মাজহারুল ইসলামের পরিবার অভিযোগ করেছেন, মাজহারুল ইসলামকে র‌্যাব তুলে নিয়ে যায়। তারপর নির্যাতন করে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

 

     ৮ই সেপ্টেম্বর তার পরিবার বলে, সিঙ্গারহাট বাজারে একটি চায়ের দোকান থেকে মাজহারুলকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। পরে তাকে তার বাড়িতে আটকে রাখে। এ সময় র‌্যাব সদস্যরা তার ওপর নির্যাতন করেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এরপর তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় র‌্যাব। সেখানে ৯ই সেপ্টেম্বর মারা যান তিনি। হাসপাতাল থেকে রিপোর্টে বলা হয়, মাজহারুলের শরীরে বহু ক্ষত ছিল। ১৮ই সেপ্টেম্বর তার স্ত্রী শামিমা আখতার স্বপ্না র‌্যাব-৫ এর কোম্পানি কমান্ডারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে একটি হত্যা মামলা করেন। এজন্য স্বপ্নাকে মোবাইল ফোনে হুমকি দেয়া হয়। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় অফিসের নেতাকর্মীদের মধ্যে সহিংস সংঘাত হয়েছে। এমন ঘটনায় ২০১৭ সালের প্রথম নয় মাসে ৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৩৫০৬ জন।

 

   জাতীয় নির্বাচন যখন ঘনিয়ে আসছে তার আগে ক্ষমতার লড়াইয়ে রাজনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘাত হয়। এতে আহত হন ৫৬ জন। গুলিতে আহত যুবলীগের এক তরুণ নিহত হন। ওই রিপোর্টে বাংলাদেশে গুম সম্পর্কে তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপ ও মিডিয়ার রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে গুম ও অপহরণ অব্যাহত রয়েছে। এর জন্য বেশির ভাগই দায়ী নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। অভিযুক্ত এমন গুমের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা কিছু মানুষকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই মুক্তি দিয়েছে। গ্রেপ্তার দেখিয়েছে কাউকে। আবার কাউকে পাওয়া গেছে মৃত অবস্থায়। অন্যদের কোনো খোঁজই পাওয়া যায়নি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ওই বছরে ৬০টি জোরপূর্বক গুমের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালের আগস্টে কর্তৃপক্ষ বিরোধীদলীয় তিনজন সাবেক রাজনীতিকের ছেলেদের নিরাপত্তা হেফাজতে নেয়।

 

    সাত মাস পরে কর্তৃপক্ষ তার মধ্যে হুম্মাম হাদের চৌধুরীকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু বছরের শেষ পর্যন্ত মীর আহমেদ বিন কাশেম ও আমান আজমি ছিলেন নিখোঁজ। ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস থেকে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এতে দাবি করা হয়, কমপক্ষে ৪০ জন গুম হয়েছেন। জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স বাংলাদেশ সফরের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করে। কিন্তু তাদের সেই অনুমতি দেয়া হয়নি। ওদিকে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বার বার জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাদের দাবি, ভিক্টিম নিজের ইচ্ছায় পালিয়ে আছে। তবে ৪ঠা জুলাই বিচার বিভাগীয় এক তদন্তে বলা হয়, জোরপূর্বক গুমের ঘটনা ঘটেছে এবং নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয়া হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে।

 

   এপ্রিল মাসে র‌্যাবের একজন সিনিয়র অফিসার সুইডিশ রেডিওকে সাক্ষাৎকার দেন। তাতে তিনি স্বীকার করেন যে, তার ইউনিট নিয়মিতভাবে বিভিন্ন জনকে তুলে নিয়ে যায়, তাদেরকে হত্যা করে এবং মৃতদেহ ফেলে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই রিপোর্টে খেয়াল-খুশিমতো গ্রেপ্তার আটকের বিষয়টিও তুলে আনা হয়। বলা হয়, এমন গ্রেপ্তার বা আটক সংবিধান অনুমোদন করে না। কিন্তু ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে কর্তৃপক্ষ কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই যে কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করতে পারে। আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তাদের গ্রেপ্তারকে বৈধতা দেয়ার জন্য ব্যাপকভাবে এই আইনের ব্যবহার করে থাকে। সংবিধান যেকোনো ব্যক্তিকে অবৈধভাবে গ্রেপ্তার বা আটক রাখাকে আদালতে চ্যালেঞ্জ জানানোর অধিকার দিয়েছে। কিন্তু সরকার সাধারণত এটা অনুসরণ করে না।

 

    বিশেষ দুটি গোয়েন্দা সংস্থা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। তাদের এ কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে সন্দেহজনক সন্ত্রাসী, বিরোধীদলীয় সদস্য, সুশীল সমাজ ও অন্যদের ক্ষেত্রে। একটি বাহিনী ও নিরাপত্তা রক্ষাকারী অন্য বাহিনীর ওপর বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের ভিতরে অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত করে তাদেরকে শাস্তি দেয়ার মেকানিজম আছে সরকারের। কিন্তু এই মেকানিজম নিয়মিত প্রয়োগ করা হয় না। নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা দায়মুক্তি নিয়ে নিয়ম লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। রাজনৈতিক বিক্ষোভ হোক অথবা সন্ত্রাসী ঘটনার জবাবে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের পদক্ষেপের সময় হোক- এসব ক্ষেত্রে খেয়াল-খুশিমতো গ্রেপ্তার করা হয়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই এসব ব্যক্তিকে আটক রাখে সরকার। মাঝে মাঝে তারা আটক ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করে।

 

     গত বছর পুলিশ গণগ্রেপ্তার চালিয়েছে। তারা এ সময়ে গ্রেপ্তার করেছে ১৪ হাজার মানুষকে। এর মধ্যে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী রয়েছেন প্রায় ২ হাজার। এ সময়ে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ বিভিন্ন অভিযোগে পর্যায়ক্রমে গ্রেপ্তার অভিযান চালিয়েছে। এতে বলা হয়, আইন অনুযায়ী বিচার বিভাগ স্বাধীন। তবে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে সেই স্বাধীনতা নিয়ে আপস করা হয়েছে। ২০১৪ সালে ষোড়শ সংশোধনী পাস করে জাতীয় সংসদ। এর ফলে পার্লামেন্ট কোনো বিচারপতিকে অপসারণের অধিকার পায়। কিন্তু গত বছরে সুপ্রিম কোর্ট ওই সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলে রুল দেয়। এর ফলে তখনকার প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে পার্লামেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী। এর ফলে পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি ও তিনি দেশ ছেড়ে যান। তখনকার ওই প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার দাবি, সরকার তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে।

 

     তবে সরকার এমন অভিযোগ অস্বীকার করে। উল্টো বছরের শেষের দিকে ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনে সরকার। মানবাধিকার বিষয়ক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এটা করা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক। রাজনৈতিক কারণে বন্দি রাখা বা জেলে আটকে রাখার রিপোর্ট পাওয়া গেছে। বিরোধীদলীয় অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি বলেছে, খেয়াল-খুশিমতো গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের নেতাকর্মীদের। এতে আরো বলা হয়, আইনে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অনুমতি থাকলেও এই অধকারকে সীমিত করে দিয়েছে সরকার। আইন সরকারকে কোনো স্থানে চারজনের বেশি মানুষের সমাবেশ নিষিদ্ধ করার অধিকার দিয়েছে। ঢাকায় প্রতিবাদ, বিক্ষোভ করার আগে অনুমতি নিতে হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছ থেকে। এর মাধ্যমে বিরোধী দলের সভা সমাবেশকে চাপিয়ে রাখা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে শক্তি প্রয়োগ করে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দল।

 

    ২০১৭ সালে বিরোধী দলের সদস্যদের বহু সমাবেশ প্রতিরোধ করে দিয়েছে পুলিশ। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির শ্রম বিষয়ক কমিটি ১লা মে শ্রমিক দিবসে ঢাকায় র‌্যালি করার অনুমতি চেয়েছিল। কিন্তু তাদেরকে তা দেয়া হয়নি।

 

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ