উন্নয়ন, দুর্নীতি ও জিডিপি: একসঙ্গে বাড়ার রহস্য কী?

প্রকাশিত: ০৩ এপ্রিল, ২০১৮ ১১:১৬:০৬ || পরিবর্তিত: ০৩ এপ্রিল, ২০১৮ ১১:১৬:০৬

উন্নয়ন, দুর্নীতি ও জিডিপি: একসঙ্গে বাড়ার রহস্য কী?

এ বছর বাংলাদেশের সঙ্গে সঙ্গে আফগানিস্তান আর মিয়ানমারও 'উন্নয়নশীল' দেশের তালিকায় ওঠার জন্য যোগ্যদের তালিকায় জায়গা করে নিচ্ছে। এই যোগ্যতার পরের পরিমাপ হবে ২০২১ সালে। ২০২১ সালের পরীক্ষায় পাশ হলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ বলে ঘোষণা করবে জাতিসংঘ।

দুঃখজনক এই যে, ভয়াবহ দুর্নীতি, দারিদ্র্য আর আইনের শাসন ভেঙে পড়া এইসব দেশের সঙ্গেই আজকাল আমাদের একচেটিয়া প্রতিযোগিতা। আরেকটু উপরের দিকে তাকানোর মতো হুশও আমাদের আর অবশিষ্ট নেই। 'তাঁরা' প্রায়ই জানতে চান, 'এতই যদি দুর্নীতি, তাহলে জিডিপি বাড়ে কেন'? যেন দুর্নীতি হলে জিডিপি বাড়ার সুযোগ নেই! অথচ অর্থনীতিতে লেনদেন বাড়লেই জিডিপি বাড়ে।

সেই অর্থে রাস্তা, কালভার্ট, ব্রিজ বা ফ্লাইওভার নির্মাণে যতই লুটপাট হোক; এমপি, নেতা, ঠিকাদার মিলে যতই ভাগ-বাটোয়ারা করুক, যতই লাফিয়ে লাফিয়ে প্রকল্প ব্যয় বাড়ুক—টাকার লেনদেন তো বাড়ছে, তাই জিডিপিও বাড়বে।

যেমন এক রাস্তা অনর্থক দশবার কাটাকাটি, ভাঙ্গাভাঙ্গি করলেও জিডিপি বাড়ে, দেশের অর্ধেক মানুষ পানি দূষণ, বায়ু দূষণ, বা সীসা দূষণের কারণে ভয়াবহ সব অসুখ বিসুখে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও জিডিপি বাড়ে, ঢাকার 'লাইফলাইন' খাল এবং নালাগুলো দখল করে প্রভাবশালীদের বহুতল মার্কেট তৈরী হলেও জিডিপি বাড়ে।

যেমন, গ্লোবাল কম্পেটিটিভ ইনডেক্স বলছে এশিয়ার মধ্যে নেপালের পরেই সবচেয়ে খারাপ রাস্তা বাংলাদেশে১। অন্যান্য দেশের তুলনায় দ্বিগুণ–তিনগুণ অর্থ ব্যয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হলেও কয়েক বছরের মাথায় ভয়াবহ দুর্গতি হচ্ছে রাস্তাগুলোর। দ্রুত পুনর্নিমাণ করার প্রয়োজন পড়ছে।

অর্থাৎ আবারো নতুন বাজেট, নতুন লেনদেন, নতুন ভাগ-বাটোয়ারা, নতুন চুরি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, প্রকল্প ব্যয় বা চুরির পরিমাণ বাড়লে জিডিপি বাড়াই স্বাভাবিক। কারণ জিডিপি কেবল 'ফাইনাল প্রোডাক্টে'র মূল্যমান বোঝে। কে পেলো টাকার ভাগ: নেতা, জনগণ না ঠিকাদার, সেই হিসাবের দায় জিডিপির নেই।

তবে দুর্নীতির টাকা যতক্ষণ দেশে আছে, এবং দেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে, ততক্ষণই দুর্নীতি বা লুটপাটের সঙ্গে জিডিপির কোনো বিরোধ নেই। যেমন জেনারেল সুহার্তোর সময়ে ইন্দোনেশিয়া ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ দেশ। আবার একই শাসনামলে ইন্দোনেশিয়ার জিডিপি এবং মাথাপিছু আয় বেড়েছে।

অর্থাৎ দুর্নীতির টাকা দেশের ভেতরেই ছিল, এবং তা উৎপাদন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখছিল। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্রটি এতো সরল নয়। এখানে মহামারির মতো দুর্নীতি হচ্ছে, ক্ষমতাবানদের যোগসাজশে অবাধে ব্যাংক 'ডাকাতি' হচ্ছে, সরকারের কাছের লোকজন বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হচ্ছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত লুটের টাকা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে।

আমরা জানি, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারিতে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা খুইয়েছিলেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা২। এর একটা বড়ো অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। 'গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্ট্রিগ্রিটি'র রিপোর্ট বলছে, গত দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা৩! অর্থাৎ এটা আমাদের জাতীয় বাজেটেরও দ্বিগুণ!

এখানে দুটি প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক। প্রথমত, বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যাংক থেকে লুট হয়ে গেলেও সামগ্রিক অর্থনীতিতে তার সরাসরি প্রভাব কতটা? দ্বিতীয় প্রশ্ন, লুটপাট ও দুর্নীতির টাকার একটি বড় অংশ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, তারপরও জাতীয় মাথাপিছু আয়ে তার প্রভাব পড়ছে না কেন?

প্রথমত, আন্তর্জাতিক ঝুঁকি যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছে৪ (এর পরেও একের পর এক নতুন ব্যাংকের অনুমোদন পাচ্ছে ক্ষমতাসীনেরা!)। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রই বলছে ব্যাংকিং খাতের 'অব্যবস্থাপনা' (পড়ুন লুটপাট) কাটিয়ে উঠতে গত ৯ বছরে তাদের প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেয়া হয়েছে৫।

সবচাইতে খারাপ সংবাদটি হচ্ছে, একে একে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সব অন্যায় আব্দারগুলো মেনে নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক! সরকারি ব্যাংকের হেফাজতে থাকা জনগণের রক্ত পানি করা আমানতের ৫০ ভাগই এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তহবিলে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে! আর এ বছরের শুরুতেই লুটপাট সামলাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আরো ২০ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে ৬ রাষ্ট্রীয় ব্যাংক৬।

এই বিপুল পরিমান ভর্তুকির টাকা আসবে কোথেকে? জনগণের ঘাড়ে পাড়া দিয়ে বাড়তি ট্যাক্স, ভ্যাট আদায় করা ছাড়া আর উপায় কি? দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল, এতো সব দুর্নীতির পরেও মাথাপিছু আয় বাড়ছে কেমন করে? উত্তরটি করুণ ও বুকভাঙা। একদিকে প্রতি বছরই গড়ে ৬০-৭০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে৭, আরেকদিকে খেয়ে না খেয়ে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে বছরে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে প্রবাসী শ্রমিক৮।

টাকা পাচার, ব্যাংক লুট, হরিলুট, এতো সবকিছুর পরেও তাই মাথাপিছু আয় বাড়ছেই। খেয়াল করুন, শ্রমে ঘামে বিবর্ণ আধপেটা প্রবাসী শ্রমিকের দিনের পর দিন 'কম খাওয়া' মেনুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের প্রাণভোমরা।

রক্ত পানি করা এই বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্সের দাপটেই আজ 'তারা' বলতে পারেন, 'চার হাজার কোটি টাকা কিস্যু না'! রিজার্ভের ৮০০ কোটি টাকা 'কে' বা 'কারা' স্রেফ লুটেপুটে খেয়ে ফেললেও আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে বাংলাদেশ সেন্ট্রাল ব্যাংক।

তাহলে উন্নয়নের দেশে কেমন আছে অর্থনীতির চাকা ঘোরানো সেই মানুষগুলো? সত্য এটাই যে তারা ভালো নেই। উন্নয়নের দেশে কৃষক বছরের পর বছর ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় না। উন্নয়নের দেশে এশিয়ার সবচাইতে কম মজুরিতে৯ এবং সবচাইতে বেশি ঝুঁকিতে কাজ করে গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকেরা১০।

উন্নয়নের দেশে টিকতে না পেরে বিদেশে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে গিয়ে ১৩ বছরে লাশ হয়ে ফেরে ৩৩ হাজার শ্রমিক১১। জনগণের নিরাপত্তা, পরিবেশ, অর্থনীতি, বা আইনের শাসন—এই সবগুলো ক্ষেত্রেই প্রতিটি দেশি–বিদেশি জরিপ দেখাচ্ছে সবকিছু ভেঙে পড়ার এক ভয়াবহ চিত্র।

কানাডিও গবেষক নাওমি ক্লেইন তার ‘নো-লোগো’ বইতে দেখিয়েছিলেন পণ্যের ব্র্যান্ডিং আর বিজ্ঞাপনের পিছনে বিরামহীন অর্থ ব্যয় করে কোম্পানিগুলো, পাশাপাশি ভয়াবহ কাটছাট চলে শ্রমিকের মজুরিতে। বাংলাদেশের উন্নয়নটা ঠিক এমনই।

অভাব, অন্যায়, আর ভয়াবহ বিচারহীনতার দেশে বিপুল টাকা পয়সা খরচ করে উন্নয়ন নামক পণ্যের ঢাক-ঢোল পিটানোটাই এখন সরকারের একমাত্র 'এস্কেইপ রুট'। জনগণকে বিভ্রান্ত করে রাখার একমাত্র পন্থা। কিন্তু ক্রমাগত ঘা খাওয়া, লাথি খাওয়া মানুষের জানতে আর বাকি নেই, এই চোখ ধাঁধানো উন্নয়নের ব্র্যান্ডিং আসলে একটি 'গোয়েবলসীয়' প্রচারণা, একটি ভয়াবহ তামাশা।

আগের কিস্তি: সত্যি সেলুকাস এ এক অদ্ভুত উন্নয়নের দেশ!

তথ্যসূত্র:-

১. গ্লোবাল কম্পেটিটিভ ইনডেক্স ২০১৭-১০১৮।

২. প্রথম আলো, সাত বছরে আত্মসাৎ ৩০ হাজার কোটি টাকা। মার্চ ২৮, ২০১৬।

৩. গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি ২০১৭, ইলিসিট ফিনান্সিয়াল ফ্লোওস টু এন্ড ফ্রম ডেভেলপিং কান্ট্রিস: ২০০৫-২০১৪

৪. দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ফেব্রুয়ারী ১৭, ২০১৮।

৫. বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০১৭-২০১৮, প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা। সিপিডি।

৬. দৈনিক ইত্তেফাক, মূলধন ঘাটতি পূরণে রাষ্ট্রয়াত্ব ব্যাংকগুলো চেয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৮।

৭. প্রথম আলো, এক বছরে ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার, মে ৩, ২০১৭।

৮. বাংলাদেশ ব্যাংক, মান্থলি ডাটা অফ রেমিটেন্স ২০১৬-২০১৭

৯. বণিক বার্তা, এশিয়ার সর্বনিম্ন মজুরি বাংলাদেশ, জুলাই ১৫, ২০১৭।

১০. ২০১৭ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বেঞ্চমার্ক স্টাডি, ইউনাইটেড স্টেইটস ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি এসোসিয়েশন।

১১. বাংলাদেশ অক্যুপেশনাল সেইফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশন ২০১৭।

প্রজন্মনিউজ২৪/মোঃজিবুর রহমান

এ সম্পর্কিত খবর

ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৫ ইউনিট

দেশটা এখন আওয়ামী মগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে : মির্জা ফখরুল

ভোট দিতে গিয়ে শুনলেন তিনি মারা গেছেন, নিরাশ হয়েই ফিরলেন বৃদ্ধা

ইরানে হামলার পর নাগরিকদের ইসরায়েল ছাড়তে বলল অস্ট্রেলিয়া

মুস্তাফিজকে কেন পুরো আইপিএল খেলতে দিচ্ছে না বাংলাদেশ

খিলগাঁওয়ে পরিত্যক্ত ঘরে যুবকের ঝুলন্ত মরদেহ, পুলিশের ধারণা হত্যা

ছাত্রলীগ নেতার পর একই নারীর সঙ্গে ইউপি চেয়ারম্যানের ভিডিও ভাইরাল

কণ্ঠের সুরক্ষায় ঝাল-তৈলাক্ত খাবার পরিহারের পরামর্শ

৩টি ড্রোন ধ্বংস করল ইরান, নিরাপদে আছে ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনা

আগামীকাল ফিটনেস পরীক্ষা, থাকছেন কি সাকিব?

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন





ব্রেকিং নিউজ