নির্বাচনের বছরে ব্যয় বাড়াচ্ছে সরকার

প্রকাশিত: ২৩ মার্চ, ২০১৮ ০৩:০৪:১১

নির্বাচনের বছরে ব্যয় বাড়াচ্ছে সরকার

মেয়াদের শেষ বছরে এসে ব্যয় বাড়াচ্ছে সরকার। নির্বাচনের বছরে মূলত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেই খরচ করা হচ্ছে বেশি। ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় হতে সাংসদদের স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ-মন্দির নির্মাণে টাকা দেওয়া হচ্ছে। আবার প্রশাসনকেও খুশি করতে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।

এই বাড়তি খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়কে। টাকা জোগাড় করতে সরকারকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ঋণ নিতে হচ্ছে। এতে সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধে অর্থ ব্যয় হচ্ছে অনেক বেশি। সরকারি খরচের জোগানের প্রধান উৎস হচ্ছে রাজস্ব আদায়। চলতি অর্থবছরের সাত মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলামের মতে, সরকার নির্বাচনের বছরে খরচ বাড়াচ্ছে। ভোটারদের ভোট কিনতেই পরোক্ষভাবে এসব করা হচ্ছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সরকার খরচ বাড়ালেও আয় খুব বেশি বাড়াতে পারছে না। এডিপির খরচ কমানো হলেও বছর শেষে দেখা যাবে, তা-ও বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

এডিপির আকার নিয়ে প্রশ্ন

উন্নয়ন প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়িত না হওয়ায় প্রতিবছর এডিপির আকার ছোট করা হয়। এটা রেওয়াজ হয়ে গেছে। এবার তা করা হলেও কৌশল করা হচ্ছে। সংশোধিত এডিপির আকার ‘লোক দেখানো’ কমানো হয়েছে। সংশোধিত এডিপি পাসের পর মন্ত্রণালয়গুলোর বাড়তি বরাদ্দ দেওয়ার চাপও সামলাতে হচ্ছে। এখন মন্ত্রণালয়গুলোর বাড়তি বরাদ্দের দাবি যাচাই করে বরাদ্দ দেওয়া হবে। পরে তা সংশোধিত বাজেট পাসের সময় সমন্বয় করা হবে। এই কৌশলের কারণে সরকারের খরচ আরও বাড়বে।

চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির আকার ছিল ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে আপাতত ৬ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। এর মধ্যে বিদেশি সহায়তার ৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা আর স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের খরচ কমানো হয়েছে ১ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। তবে দেশজ টাকার বরাদ্দ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। মন্ত্রণালয়গুলোর নতুন বরাদ্দ সবই দেওয়া হবে দেশজ উৎসের টাকায়।

নতুন প্রকল্প পাসের হিড়িক

চলতি অর্থবছরের প্রায় সাড়ে সাত মাসে ১৮টি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা হয়েছে। সভাগুলোতে দেড় শর মতো প্রকল্প পাস হয়েছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি ছিল নতুন প্রকল্প। বেশির ভাগ প্রকল্প রাস্তাঘাট নির্মাণের। চলতি এডিপিতে এর জন্য বরাদ্দ ছিল না। এখন নতুন করে বরাদ্দ দিতে হচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়গুলোকে বাড়তি বরাদ্দ দেওয়ার পরও শেষ পর্যন্ত পাস হওয়া নতুন প্রকল্পগুলোর জন্য ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা দিতে হবে।

 

তবে সরকার বাধ্য হয়েও কিছু প্রকল্প নিয়েছে। যেমন মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য নোয়াখালীর ভাসানচরে পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত নভেম্বর মাসে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা প্রকল্প পাস করা হয়েছে। পুরোটাই দেশজ টাকায় হবে।

সাংসদদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ

এত দিন রাস্তাঘাট নির্মাণেই সাংসদেরা বিশেষ বরাদ্দ পেতেন। এবার স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ-মন্দির নির্মাণের জন্য তাঁরা বরাদ্দ পাচ্ছেন। একটু ভিন্ন কৌশলে তা করা হচ্ছে। রাস্তাঘাট নির্মাণের প্রকল্পে আট বছর ধরে সরাসরি প্রত্যেক সাংসদকে ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এবার স্কুল, মসজিদ-মন্দির নির্মাণের জন্য পৃথক তিনটি প্রকল্প পাস করা হয়েছে। নতুন কৌশল হলো প্রকল্পের সারসংক্ষেপে সাংসদদের ইচ্ছায় এগুলো তৈরি করা হবে, তা বলা নেই। কিন্তু শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর প্রত্যেক সাংসদের ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় ১০টি নতুন বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল ভবন নির্মাণ, ১০টি পুরোনো স্কুল ভবনগুলোর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা এবং এক কোটি টাকার মসজিদ মন্দির নির্মাণ করে দেবে। ইতিমধ্যে সাংসদেরা তাঁদের চাহিদাপত্র দেওয়া শুরু করেছেন। মূলত নির্বাচনের বছরে ভোটারদের তুষ্ট করতেই প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকার এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

সাংসদদের ইচ্ছা অনুযায়ী মাদ্রাসা, গণশৌচাগার, হাটবাজার নির্মাণের জন্য আরও তিনটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে জমা আছে। এই তিনটি প্রকল্পে প্রস্তাবিত খরচ ধরা হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি।

আবার অর্থমন্ত্রী গত বুধবার নতুন করে ১ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করতে আগামী বাজেটে ৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার কথা বলেছেন। এর পেছনেও নির্বাচন ভাবনা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

নির্বাচনের বছরে বড় প্রকল্পগুলো আরও বেশি দৃশ্যমান করতে চায় সরকার। তাই পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতু রেলসংযোগ, মেট্রোরেল, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার রেলসংযোগ প্রকল্প, পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণের মতো বড় প্রকল্পে বরাদ্দ তেমন কমানো হচ্ছে না। এই পাঁচটি প্রকল্পে মূল এডিপিতে মোট ১৮ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে।

সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি সুবিধা

উপসচিবেরা গাড়ি কেনার জন্য বিনা সুদে ৩০ লাখ টাকা পাবেন। আর চালকের বেতন ও গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হবে। গত অক্টোবর মাসে এই গাড়ি ব্যবহারে প্রাধিকারে উপসচিবদের আনা হয়। কেবল প্রশাসন ক্যাডার এই সুবিধা পাবে। এর আগে যুগ্ম সচিবেরা কেবল এই সুবিধা পেতেন। বর্তমানে ১ হাজার ৫৫২ জন উপসচিব আছেন। সবাইকে একযোগে গাড়ি কেনার ঋণ দিলে সরকারের লাগবে ৪৬৫ কোটি টাকা। চালকের বেতন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য খরচ হবে বছরে ৯৩ কোটি টাকা। নতুন এই নীতি করায় সরকারকে সংশোধনী বাজেটে অবশ্যই বাড়তি বরাদ্দ রাখতে হবে।

সরকারের খরচ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বাড়তি খরচের জোগান দিতে হলেও তা বাজেট শৃঙ্খলায় ব্যত্যয় হবে না। নির্বাচনের বছরে এসে রাজনৈতিক সরকারের খরচ বাড়বেই। তবে বাজেটে যে খরচ ধরা হয়েছে, তা মানসম্পন্নভাবে বাস্তবায়ন করাই জরুরি। মূল এডিপি পুরোটাই বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তিনি এ-ও বলেন, বাজেটের জন্য সম্পদ চাইলে বৃদ্ধি করা যাবে না। সম্পদ বৃদ্ধির জন্য সক্ষমতাও দরকার। তাঁর মতে, নির্বাচনের বছরে এসে বড় প্রকল্পগুলো যদি দৃশ্যমান হয়, সেটা তো দেশের জন্য কল্যাণকর।

মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম এ নিয়ে বলেন, উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের গাড়ি কেনার জন্য বিনা সুদে ঋণ দেওয়ার কোনো মানে নেই। এতে সরকারের খরচই বাড়বে। মূলত খুশি করার জন্য এটি করা হচ্ছে।

সঞ্চয়পত্রে খরচ দ্বিগুণের বেশি

সঞ্চয়পত্রের জন্য সরকারের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সঞ্চয়পত্র বিক্রির মূল ও সুদ বাবদ গ্রাহককে ১৫ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা দিতে হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্রের মূল ও সুদ পরিশোধে বরাদ্দ ছিল ২৯ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। কিন্তু জুলাই-ডিসেম্বর সময়েই ৩৯ হাজার ১৬৮ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেছে সরকার। অর্থাৎ ছয় মাসেই সারা বছরের মোট লক্ষ্যের দুই-তৃতীয়াংশ বিক্রি করে ফেলেছে। ফলে এ খাতেও ব্যয় বাড়ছে।

খরচ সামালে জোগানে চাপ

সরকারের খরচ বাড়ছেই। এই খরচের চাপ বাড়লেও জোগানে তেমন অগ্রগতি নেই। সরকারি খরচের অন্যতম জোগানদার হলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চলতি অর্থবছরে এনবিআরকে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়, যা আগের বছরের আদায় করা রাজস্বের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।

চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ১৪ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

সব মিলিয়ে নির্বাচনী বছরে সরকারের ব্যয়ে চাপ কেবলই বাড়ছে। তবে আয় না বাড়লে এতে বাজেট ব্যবস্থাপনায় সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাড়বে বাজেট ঘাটতি।

সামগ্রিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাংসদদের জন্য বিশেষ প্রকল্প নিয়েছে সরকার। এটি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এসব প্রকল্পে যাঁরা ঠিকাদারি কাজ করবেন, তাঁরা প্রবলভাবে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন। প্রকল্পের কাজে মনোযোগ থাকে না তাঁদের।

সালেহউদ্দিন আহমেদের মতে, যেভাবে খরচ বাড়ানো হচ্ছে, সেভাবে আয়ের সংস্থান করা হচ্ছে না। সার্বিকভাবে এটি অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এত দিনের অর্জনগুলোকে টেনে ধরছে। প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই না করেই নতুন নতুন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। গুণগত মান রেখে প্রকল্প শেষ করাও হচ্ছে না। এতে সম্পদের অপচয় হচ্ছে। এক টাকার কাজ চার টাকায় করতে হচ্ছে। অন্যদিকে এই অর্থের জোগান দিতে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে এনবিআর।

(প্রজন্মনিউজ২৪/মোনায়েম)

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ