সব স্বজনকে চাকরি দেন লোকমান 'মামা'

প্রকাশিত: ২৭ জানুয়ারী, ২০১৮ ১২:০৯:১৬

সব স্বজনকে চাকরি দেন লোকমান 'মামা'

কথায় বলে, 'মামা'র জোর থাকলে চাকরির অভাব হয় না। বাংলাদেশ রেলওয়েতেও এমন একজন 'মামা' রয়েছেন, যার প্রভাবে সেই সোনার হরিণ মিলে যায় খুব সহজে। এই 'মামা'র নাম লোকমান হোসেন।

রেলের শ্রমিক নেতা হওয়ার সুবাধে নিজের ছেলেমেয়ে, ভাইপো-ভাতিজি, ভাগ্নে-ভাগ্নি, ভাগ্নে বউ, নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজনকে চাকরি পাইয়ে দিয়ে প্রবাদের সেই 'মামা'র খ্যাতি পেয়েছেন তিনি। শুধু চাকরিই নয়, আপনজনদের ভালো ভালো জায়গায় পদায়ন ও ভালো কোয়ার্টারে থাকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন প্রভাবশালী এই শ্রমিক নেতা।

লোকমান হোসেনের পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের মধ্যে এখন চাকরি নেওয়ার মতো তেমন কোনো সদস্য নেই বললেই চলে। রেলের আইন কর্মকর্তা, টিটিই, ওয়েলফেয়ার ইন্সপেক্টর, পোর্টার, খালাসি, এমএলএসএস, দারোয়ান, চৌকিদার, আয়াসহ এমন কোনো পদ নেই যেখানে তার কোনো না কোনো স্বজন নেই। তাদের ঘরে ঘরেই রেলের চাকরিজীবী। কোটাসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে অর্ধশতাধিক লোককে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন তিনি। সমকালের অনুসন্ধানে তাদের অন্তত ২০ জনের নাম পাওয়া গেছে।

রেলের পূর্বাঞ্চলের চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার অফিসে প্রধান অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করতেন শেখ মো. লোকমান হোসেন। বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বিভিন্ন সময় অনুকূল সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় ইচ্ছেমতো নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনদের দেদার চাকরি দিয়েছেন।

রেলের কোনো পদে নিয়োগ কার্যক্রম শুরু হলেই ইস্যু তৈরি করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। এরপর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে চাপে ফেলে সুবিধা আদায় করেন বলে অভিযোগ রয়েছে লোকমানের বিরুদ্ধে। গত আগস্টে অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে গেলেও এখনও তার দাপট কমেনি। এমনকি অফিসের চেয়ার পর্যন্ত ছাড়েননি। চট্টগ্রামের সিআরবিতে নিজের চেয়ারে বসেই রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের খবরদারি করছেন তিনি।

এ ব্যাপারে রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক সমকালকে বলেন, 'শুধু শ্রমিক নেতা লোকমান হোসেন নন, নিয়োগ কার্যক্রম শুরু হলে অনেক সংগঠনের অনেক নেতাই ডজন ডজন তদবির নিয়ে হাজির হন। প্রত্যেকবার প্রত্যেক পদেই তারা তদবির করে থাকেন। গণহারে তদবির আসে তাদের কাছ থেকে। কাজ না হলে বিদ্রোহ করেন। সুবিধা নেওয়ার জন্যই তারা এসব করেন। তারপরও নিয়োগ কমিটি নীতিমালার আলোকে নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।'

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের হেডকোয়ার্টার সিআরবিতে আইন দপ্তরের সিআই পদে কাজ করছেন লোকমান হোসেনের মেয়ে জিনিয়া নাসরিন। চট্টগ্রামে জুনিয়র টিটিই হিসেবে কর্মরত রয়েছেন তার ছেলে সাইমুম হোসেন। সংস্থাপন অফিসে এমএলএসএস হিসেবে কাজ করেন তার মেয়ে তানজিদা আকতার। জিনিয়া ও সাইমুম তার প্রথম স্ত্রীর ছেলেমেয়ে এবং তানজিদা তার দ্বিতীয় স্ত্রীর মেয়ে। রেলের ঢাকা বিভাগে কর্মরত ওয়েলফেয়ার ইন্সপেক্টর মো. হাসেম তার ভাগ্নে। কয়েক মাস আগে হাসেমের বউ রিমা আকতার চাকরি পেয়েছেন। চট্টগ্রাম স্টেশনে পোর্টার হিসেবে কাজ করছেন তিনি। সর্বশেষ রেলে নিয়োগ পাওয়া তিনজন পোর্টারের একজন রিমা। ভাগ্নে হাসেমের ভাই মো. আজিম খালাসি হিসেবে নিয়োগ পেয়ে এখন চট্টগ্রামের সিআরবি

পাওয়ার হাউসে কাজ করছেন। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমার্শিয়াল অফিসের আওতায় প্রেষণে গার্ড হিসেবে কাজ করছেন লোকমানের ভাতিজা নেজাম উদ্দিন ও জুনিয়র টিটিই শাহাদাত হোসেন, চিফ ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার অফিসে এমএলএসএস পদে কাজ করছেন তার ভাতিজা আবু খালেদ, একই অফিসে এমএলএসএস পদে আছেন নাতি রিদোয়ান হোসেন, চট্টগ্রামের বাড়বকুণ্ড স্টেশনের পোর্টার মো. বাবুলও তার ভাইয়ের ছেলে। ডিভিশনাল কমার্শিয়াল অফিসের অধীনে স্টেশনে কর্মরত আরাফাত হোসেন তানভীর সম্পর্কে লোকমান হোসেনের নাতি হন। আকতার হোসেন ও রোকসানা আকতার নামে তার দুই ভাইপো-ভাতিজি কাজ করছেন চট্টগ্রাম ডিভিশনাল কমার্শিয়াল অফিসে, সিআরবিতে আয়া হিসেবে কর্মরত বেবী আকতারও তার ভাতিজি। খালাসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর সিআরবির পাওয়ার হাউসে কাজ করছেন তার ভাতিজি আয়েশা আক্তার। এছাড়া সিআরবির রেলওয়ে মেডিকেলে চৌকিদার পদে রয়েছেন লোকমানের ভাতিজা আমিনুল ইসলাম, খালাসি পদে নিয়োগ পাওয়া আরেক ভাতিজা মো. আফসার হোসেন ও ক্লিনার হিসেবে কাজ করছেন ভাতিজি বেলী আকতার। এবার রেলে ৮৬৫ জনকে খালাসি পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে। এ পদেও তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন আত্মীয়ের নাম রয়েছে বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক রেল শ্রমিক লীগ নেতা সমকালকে বলেন, 'রেলে পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয় ছাড়াও পাড়া-প্রতিবেশীকেও চাকরি দিয়েছেন লোকমান হোসেন। নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন সময় একাই প্রায় একশ' লোককে চাকরি দিয়েছেন। একইসঙ্গে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়েছেন।'

আপনজনদের ভালো ভালো জায়গায় পদায়নও করেছেন লোকমান। ভালো ভালো কোয়ার্টারে থাকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন। তার মেয়ে জিনিয়া নাসরিনের নামে বরাদ্দ রয়েছে চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলীর আমবাগান অফিসার্স কলোনির এ/২২ নম্বর বাংলোটি। কিন্তু সেখানে তিনি থাকেন না। বাংলোটি ভাড়া দেওয়া হয়েছে। বাংলোর উন্মুক্ত জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে এক ও দুই কক্ষ বিশিষ্ট ৭-৮টি ঘর। এগুলোও ভাড়া দিয়েছেন জিনিয়া। বাবা নেতা হওয়ায় কিছুই করতে পারছে না অসহায় রেল কর্তৃপক্ষ। লোকমানের ছেলে জুনিয়র টিটিই সাইমুম হোসেনের নামেও একটি বাসা বরাদ্দ রয়েছে আমবাগান এলাকায়। তার ভাগ্নে রেলের ওয়েলফেয়ার ইন্সপেক্টর মো. হাসেমের নামে বরাদ্দ রয়েছে টাইগারপাস এলাকার ডিএসআর/৪/এ নম্বরের বাসাটি। অন্য আত্মীয়স্বজনরাও ভোগ করছেন নানা সুযোগ-সুবিধা।

সমকালের অনুসন্ধানে উঠে আসা পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনদের নাম তুলে ধরে তারা কীভাবে রেলে চাকরি পেলেন জানতে চাইলে লোকমান হোসেন সমকালকে বলেন, তিনি শুধু তার ছেলেমেয়ে ও আত্মীয়স্বজনকে চাকরি দেননি, অনেক নিরীহ ও সাধারণ লোককেও রেলে চাকরি দিয়েছেন। তার ছেলেমেয়ে ও ভাইপো-ভাতিজিদের মধ্যে যারা চাকরি করছেন, তাদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা ও কেউ কেউ পোষ্য কোটায়ও চাকরি পেয়েছেন। প্রভাব খাটিয়ে স্বজনদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, শ্রমিক রাজনীতি করে তারা মানুষের উপকার করেছেন। আর চাকরি করার কারণে অন্যদের মতো তার ছেলেমেয়েরাও ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। এটা অন্যায় নয় বলে জানান তিনি।

দৈনিক সমকালের সৌজন্যে
প্রজন্মনিউজ২৪/নুর

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ