রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি

কানা মামা ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে, এ আশঙ্কা থেকেই যায়

প্রকাশিত: ২৫ জানুয়ারী, ২০১৮ ১১:০৫:৪৭

কানা মামা ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে, এ আশঙ্কা থেকেই যায়

সব সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে একটি চূড়ান্ত চুক্তি হয়েছে। এ আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয় দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবের নেতৃত্বে গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) বৈঠকে। চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে ‘সম্ভব হলে’ দুই বছরের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শেষ করা হবে। জানা যায়, প্রতি কার্যদিবসে ৩০০, অর্থাৎ সপ্তাহে ১ হাজার ৫০০ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফেরত নেবে। আবার অন্য একটি সূত্রের মতে, সপ্তাহে নেবে ৭৫০।

তবে সংখ্যাটি পরবর্তী সময়ে আরও পর্যালোচনা করে বাড়ানো হবে বলেও তারা আশ্বাস দিয়েছে। রাখাইনে পৌঁছানোর পর তাদের জন্য দুটো অভ্যর্থনা শিবির চালু করবে। সেখান থেকে নেওয়া হবে মংডুর একটি অস্থায়ী শিবিরে। তারপর তাদের ঘরবাড়ি তৈরি করে সেখানে পাঠাবে।

অন্যদিকে আমাদের পররাষ্ট্রসচিব বলেছেন, প্রত্যাবাসনের কাজ সুচারুভাবে করতে হলে জাতিসংঘ, বিশেষ করে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, জাতিসংঘকে যুক্ত করা না হলে প্রত্যাবাসন শেষে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন এবং মিয়ানমারের সমাজে তাদের অন্তর্ভুক্তি টেকসই করা যাবে না। এ ভাবনা থেকেই জাতিসংঘকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয় এসেছে। বলা হচ্ছে বাংলাদেশ এ বিষয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। এদিকে ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন-প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়েছে। সম্প্রতি জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের একজন মুখপাত্র বলেছেন, প্রত্যাবাসনের জন্য সবার আগে প্রয়োজন রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি। তা করতে ইউএনএইচসিআর ও তার অংশীদারদের অবারিত চলাচল নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাঁর মতে, কিছু কিছু সংস্থাকে উত্তর রাখাইনে সীমিত পরিসরে যেতে দেওয়া হচ্ছে। তবে ইউএনএইচসিআরের কর্মীদের মংডুর বাইরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।

কোনো কোনো বিশ্লেষক চুক্তিটিকে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতি বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতে, সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন অব্যাহত আন্তর্জাতিক চাপ। তেমনি মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনাও চালিয়ে যেতে হবে। তবে প্রত্যাবাসন টেকসই করার ক্ষেত্রে তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের অধিবাসী হিসেবে যাচাই-বাছাই করা, প্রত্যাবাসনের পর অস্থায়ী শিবির থেকে দ্রুততম সময়ে আদি বাসস্থানে পাঠানো এবং সেখানকার নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা। এ বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণের কোনো সুযোগ নেই। মিয়ানমার তার নাগরিকদের যাচাই-বাছাই করা স্বাভাবিক। তবে কাগজপত্রহীন লাখ লাখ লোককে যাচাইয়ের ভিত্তি কী হবে তা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।

অন্যদিকে অস্থায়ী শিবির থেকে আদি বাসস্থানে দ্রুত ফেরানোর জন্য নতুনভাবে বাড়িঘর তৈরির কাজটি তারা কত দিনে করতে পারবে বা করবে, এ বিষয়ে সংশয়বাদী হওয়া সংগত। ব্যাপক আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। আর তা পেতে হলে ইউএনএইচসিআরসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার মোটামুটি লম্বা সময় সেখানে অবস্থান প্রয়োজন। প্রয়োজন তাদের অবারিত গতিবিধি। উল্লেখ্য, প্রত্যাবাসনের পর ঘরবাড়ি তোলা ছাড়াও প্রয়োজন রয়েছে চাষাবাদের উপকরণ সরবরাহ এবং একটি ফসল না ওঠা পর্যন্ত সহায়তা। মিয়ানমার সরকার এ বিষয়ে তাদের রক্ষণশীল মনোভাব থেকে কতটা এগিয়ে আসবে, তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।

সবশেষে থাকছে তাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার বিষয়টি। প্রকৃতপক্ষে এখানেই সমস্যা। সুপারিশটি ছিল কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনে। সেখানে এর পাশাপাশি বলা হয়েছিল তাদের দেশের অভ্যন্তরে গতিবিধি অবারিত থাকতে হবে। এটা প্রয়োজন জীবন-জীবিকা, শিক্ষা-দীক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের জন্য। আর সে প্রতিবেদন পেশের পরপরই তো নতুনভাবে আজাব নেমে আসে রাখাইনবাসী রোহিঙ্গাদের ওপর। মাত্র কয়েক দিনের অভিযানে মেরে-কেটে, আগুন দিয়ে এবং নারীদের সম্ভ্রমহানি করে প্রায় ৭ লাখ লোককে দেশান্তরি করেছে গত ২৫ আগস্ট থেকে। প্রত্যাবাসনের আলোচনা এবং চুক্তি যখন হচ্ছে তখনো থেমে নেই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে চলে আসা।

দেখা দরকার আমরা এতদসংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক এবং পরবর্তী সময়ে ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট-সংক্রান্ত চুক্তিতে ওপরের বিষয়গুলো কতটুকু আনতে পেরেছি। প্রত্যাবাসনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পুনর্বাসনের জন্য জাতিসংঘকে সংশ্লিষ্ট করা অত্যাবশ্যক। এর কোনো বিকল্প নেই-এমনটা অনেক আগে থেকে আলোচিত হচ্ছিল। আর ইউএনএইচসিআর তাদের ম্যান্ডেট অনুসারেই বলছে, প্রত্যাবাসন হবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে। সে মানদণ্ডের সূচনাতেই থাক, এটা হবে তাদের সম্মতিতে। জোর করে কাউকে পাঠানো যাবে না। আর এমনটা হতে হলে মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে এই লোকগুলো নিরাপদে থাকবে-এ ধারণা তাদের মাঝে আনতে হবে। তাদের বুঝতে হবে সেখানে গিয়ে নিজ জন্মভিটায় বাড়িঘর তুলে নিজের জমিতে আবার ফলাতে পারবে ফসল। কেউবা শ্রমজীবী হিসেবে করবে কাজ। অত্যাচার, নির্যাতন ও মহিলাদের সম্ভ্রমহানি বন্ধ হবে। এটা তো ন্যূনতম চাওয়া।

আর এর নিশ্চয়তার বিধান করতে পারে মিয়ানমার সরকার। এতে প্রয়োজন হতে পারে জাতিসংঘের সহায়তা। তারা সহায়তা দিতে আগ্রহী। এবারের রোহিঙ্গা সংকটকালে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্ক ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলো এবং জাতিসংঘ বাংলাদেশের অবস্থানের সপক্ষে যে অনড় অবস্থান নেয়, সেখান থেকে একটুও সরেনি; বরং ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের দোদুল্যমান অবস্থানে সম্ভবত বিস্মিত ও হতাশ হয় মাঝেমধ্যে। জাপানের ক্ষেত্রে সূচনায় কিছু অস্পষ্টতা থাকলেও ইদানীং তারা এ নিপীড়িত জনগোষ্ঠীটির পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের মাঝে নিরাপত্তাবোধ তৈরির আবশ্যকতার বিষয়টি তেমনটা স্থান পায়নি সর্বশেষ চুক্তিটিতে। ইউএনএইচসিআরসহ জাতিসংঘের অন্য অঙ্গ সংগঠনগুলো রাখাইন রাজ্যে ব্যাপকভিত্তিক কাজ করার সুযোগ পেলে রোহিঙ্গাদের মাঝে এ নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। তারা স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে শুরু করবে। আর ফিরে যাওয়ার জোয়ার একবার সৃষ্টি হলে তা ঈপ্সিত ফল দেবে।

এবার আসে প্রত্যাবাসনের পাটিগণিতের হিসাব। কোনো বাধাবিপত্তিহীনভাবে প্রতি সপ্তাহে ১ হাজার ৫০০ গেলেও ৫২ সপ্তাহে যাবে ৭৮ হাজার। তাহলে সাড়ে ৭ লাখের কী হবে? আমরা আশা করব, মিয়ানমার শুভবুদ্ধিপ্রণোদিত হয়ে সংখ্যাটা ক্রমান্বয়ে বাড়াবে। অবশ্য অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এ প্রক্রিয়া বারবার কোনো না কোনো কারণে ব্যাহত হয়। এর মাঝে ঝড়-বৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। সাপ্তাহিক দুটি ছুটির দিন ছাড়াও দুই দেশেরই উত্সবাদি বা জাতীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ দিবস উপলক্ষে প্রত্যাবাসন না হওয়ারই কথা।

তালিকা নিয়েও বিভ্রাট কম হবে না। পরিবারভিত্তিক তালিকা চাওয়া হয়েছে। পিতৃ-মাতৃহীন এতিম শিশু-কিশোরেরা কোন তালিকায় থাকবে, বাছাইয়ে টিকবে কি না, এসব অস্পষ্টতা এখনো কাটেনি। অবশ্য কাজটি আন্তরিকতার সঙ্গে শুরু হলে সৃষ্ট সমস্যাদি স্থানীয় পর্যায়ে সমাধানের ব্যবস্থা রাখা দরকার। সেখানে ঘন ঘন বৈঠক হতে হবে টেকনাফ-মংডুতে, ঢাকা-নেপিডোতে নয়। চুক্তির অসম্পূর্ণতা যতই থাকুক, এর প্রয়োজন ছিল। কেননা যেকোনো এক জায়গায় আমাদের শুরু করতে হবে। হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। কিন্তু এটা করার আগেই জাতিসংঘের সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক ছিল। এখনো তাদের সংশ্লিষ্ট না করে মূল কাজ শুরু করা যাবে না। নচেৎ গোড়াতেই গলদ বাধতে পারে। তালিকার ক্লিয়ারেন্স হয়তো আসবে, অভ্যর্থনা শিবির থাকবে প্রস্তুত, এখানকার ব্যবস্থাপনাও নেওয়া হবে সুচারুভাবে। কিন্তু যারা যাওয়ার তারা যদি বেঁকে বসে, তখন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে গোটা প্রক্রিয়া। আর বাস্তবতা হচ্ছে স্বদেশি-বিদেশি কিছু ব্যক্তি বা সংস্থা রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে না যেতে উসকানি দিচ্ছে। এরা সংখ্যায় কম হতে পারে। তবে খারাপ কাজ করার জন্য খুব বেশি লোক দরকার হবে না। তাই কোনো গলদ রাখা যাবে না আমাদের প্রচেষ্টায়।

তাহলে বলা চলে চুক্তি তো হলো। প্রত্যাবাসনও হয়তো শুরু হবে। হোক না সূচনায় কম পরিমাণেই। ধীরে ধীরে বাড়বে। এ আশাই তো করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। একেবারে স্থবির হয়ে থাকার চেয়ে এটা নিশ্চয়ই ভালো। তবে এভাবে তা শুরু করে বিশ্বের জাগ্রত জনমতকে বিভ্রান্ত করার ঝুঁকি যাতে আমরা না নিই, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি প্রয়োজন। জোরালো আবশ্যকতা রয়েছে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর রোহিঙ্গাবিষয়ক অবস্থানকে ক্রম জোরদার করার। ধরেই নিলাম নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। তবে সে কানা মামা ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে, এ আশঙ্কা থেকেই যায়।

প্রজন্মনিউজ২৪.কম/এ এ মাসুদ

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ