স্বাধীনতা তোমাকে খুঁজছি

প্রকাশিত: ০৫ অগাস্ট, ২০১৭ ০৬:১৫:৫২

স্বাধীনতা তোমাকে খুঁজছি

সরকারের ছত্রছায়ায় পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবর্ণনীয় নির্যাতন, নিপীড়ন, অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগের কথা পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায়। অনেক খবর অজানাই রয়ে যায়, যা পত্রিকার পাতা পর্যন্ত আসে না। সম্প্রতি তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমানকে চোখের চিকিৎসার জন্য সরকার ভারতের চেন্নাই পাঠিয়েছে। বিমানবন্দরে সিদ্দিকুর রহমানের সাক্ষাৎকার মিডিয়ায় করে প্রচার হয়েছে এ মর্মে যে, সে রাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানিয়েছে এ জন্য যে, রাষ্ট্র উন্নতি চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠাচ্ছে। সাথে এক বৃদ্ধার কান্নাও দেশবাসী শুনেছে। বৃদ্ধা মহিলা, সিদ্দিকুর রহমানের মা, অতি কষ্টে তাকে লালনপালন করেছেন, যার আশা ছিল যে আরো ১০ জনের মতোই সিদ্দিক সংসারের সহায়ক শক্তি হিসেবে সবার মুখ উজ্জ্বল করবে। মহিলার বেশভূষণ দেখে মনে হয়েছে যে, তারা কোনো সচ্ছল পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নয়। কে এই সিদ্দিকুর রহমান, কেনই বা তার চোখ নষ্ট হতে হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে! পত্রিকান্তরে প্রকাশ, তিতুমীর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র; ২০-৪-২০১৭ তারিখে রুটিন ও সেশনজট নিরসনের দাবিতে বিক্ষোভ করে পরীক্ষার বর্তমান কর্ণধার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ স ম আ সিদ্দিককে স্মারকলিপি দিতে শাহবাগ মোড়ে সমবেত হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্বতন্ত্র ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিকভাবে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়বহির্ভূত কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত ছিল। কিন্তু উপাচার্য আ আ স ম আ সিদ্দিক নিজ কারসাজিতে রাজধানীতে অবস্থিত সাতটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের পরীক্ষার নিয়ন্ত্রণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে গেছেন, যার গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা তিনি জনসমক্ষে এখনো প্রকাশ করেননি। ছাত্রদের কী অপরাধ ছিল যেখানে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ প্রয়োজন হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসা বা অফিস থেকে অনেক দূরে শাহবাগ মোড় যেখানে একটি পুলিশ স্টেশন রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়বহির্ভূত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্রদের তিনি যদি দাবিদাওয়া শোনার ধৈর্য হারিয়ে ফেলে থাকেন, তবে তাদের পরীক্ষার দায়িত্ব নিলেন কেন পত্রিকায় প্রকাশ, পুলিশ ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল থেকে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করেনি বরং আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের প্রতি সরাসরি নিক্ষেপ করেছে যাতে মনে হয়েছে ছত্রভঙ্গ নয় বরং কোনো যুদ্ধময়দানে সম্মুখযুদ্ধে শত্রু দমনে পুলিশ মাঠে নেমেছে। পত্রিকার ভাষ্য ও টেলিভিশনে প্রচারিত ফুটেজে দেখা যায় শাহবাগে অনধিক ২০০ ছাত্রের সমাবেশ হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ এক হাজার ২০০ জন অজ্ঞাত নাম দিয়ে ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, টিয়ার গ্যাস খেয়ে চোখ হারাল ছাত্ররা এবং মামলাও খেলো ছাত্ররা। যে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করেছে, তারা রয়ে গেল দুধে ধোয়া তুলসী পাতা। ফলে সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান একসময়ে বলেছিলেন, ‘মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ।’ এ বাণীই এখন সর্বস্থানে গ্রহণযোগ্য। মূলত দেশ চালায় পুলিশ। কারণ বিরোধী দলকেও রাজনৈতিক কর্মসূচি নেয়ার জন্য পুলিশের অনুমতি নিতে হয়, তাই বলতে হয় ‘স্বাধীনতা’ তুমি কোথায় ব্রিটিশ, পাকিস্তান একটি নির্জীব যন্ত্র হিসেবে যেভাবে পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে, বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। সভা, সমাবেশ, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ করা প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সে অধিকার আজ পুলিশের বুটের নিচে পিষ্ট হয়ে গেছে। তাই আর্তনাদ আসে, হে মহান ‘স্বাধীনতা’ তুমি কোথায়

ন্যায্য অধিকার দাবির মিছিল প্রতিরোধ করতে যখন পুলিশের টিয়ার শেল আর রাবার বুলেটের সম্মুখীন হতে হয়, তখন গণতন্ত্র সত্যিকার অর্থেই প্রশ্নবিদ্ধ। হামলায় শিক্ষার্থীরা কেবল আহত হয়েছে তা নয়, একজন শিক্ষার্থী এমনভাবে আহত হয়েছে যে তার চোখ হারাতে হয়েছে। চেন্নাই হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে যে, তার চোখে আর আলো আসবে না। ছাত্রদের দাবি ছিল অবিলম্বে রুটিনসহ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা নিয়ে। পুলিশের টিয়ার শেল আর রাবার বুলেট দিয়ে অধিকার আদায়ের দাবির জবাব দেয়া হয়েছে; যেমন জবাব দিয়েছিল ব্রিটিশ ও পাক বাহিনী। ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, কবি নজরুল ইসলাম কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও মিরপুর বাঙলা কলেজ মোট সাতটি কলেজকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আওতায় না রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তকরণের কারণে পরীক্ষার রুটিন ঘোষণার দায়িত্ব অবশ্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সাম্প্রতিক সমস্যায় শিক্ষাজীবন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কায় শিক্ষার্থীরা দাবি তোলে। শিক্ষার্থীরা সেই ন্যায্য দাবি তোলায় তাদের ওপর পুলিশ টিয়ার শেল আর রাবার বুলেট দিয়ে প্রতিহত করে। পুলিশের ভাষ্যমতে, নাগরিক দুর্ভোগ এড়াতে শিক্ষার্থীদের শাহবাগ এলাকা থেকে সরে যেতে বলার পরও তারা সরে না যাওয়ায় এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কয়েক মাস আগে শাহবাগেই সরকারসমর্থক ছাত্রসংগঠনের সমাবেশের কারণে সারা দিন শহরে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তখন কি নাগরিক দুর্ভোগ হয়নি কোথায় দেশবাসীর বাকস্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার মনে রাখা উচিত দাবি পেশ, বিক্ষোভ করা এবং সমাবেশের অধিকার নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার এখন পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতেই জিম্মি। গত কয়েক বছরে ছাত্রদের ন্যায্য দাবি আদায়ের মিছিলে বিক্ষোভ করার ঘটনায় এবং সমাবেশের ঘটনায় পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছত্রভঙ্গের তোপে পড়ে বীভৎস ঘটনার জন্ম হয়েছে। দেখা যাচ্ছে অধিকার আদায়ে অবস্থান যারা নেবে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে বুলেট ও টিয়ার গ্যাস দিয়ে।

সরকারই পুলিশের স্বেচ্ছাচারিতার প্রশ্রয় দিয়েছে। মিছিলের ওপরে নির্বিচারে গুলি পুলিশের কোনো নতুন ঘটনা নয়। প্রতি বছর, প্রতি মাসেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, যার ইন্ধনদাতা সরকার নিজেই। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর কালিহাতী উপজেলার সাতুটিয়া গ্রামে রফিকুল ইসলাম রোমা ও তার ভগ্নিপতিসহ কয়েকজন ঘাটাইল থানার আলামিন ও তার মাকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করে। এ ঘটনায় এলাকাবাসী দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ঘাটাইলের হামিদপুর বাজারে ও কালিহাতী সদরে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে চারজন নিহত হন, গুলিবিদ্ধ হন আরো সাতজন। নিহতরা হলেনÑ ঘাটাইলের কালিয়া গ্রামের আজাহারের ছেলে শামীম (৩৫), কালিহাতির সাতুটিয়া গ্রামের ফারুক হোসেন (৩২), একই উপজেলার সদরের রবিদাসের ছেলে শ্যামল দাস (১৫) ও বেতডোবা গ্রামের ফারুক হোসেনের ছেলে রুবেল হোসেন (২০)। বিচারের দাবিতে মিছিল করা নিরস্ত্র গণমানুষকে হত্যার দায়ে পুলিশদের দেশের প্রচলিত আইনে বিচারের সম্মুখীন করা হয়নি, বরং নিহত ব্যক্তিদের সাথে তামাশা করা হয়েছে। প্রতিটি নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করা রাষ্ট্রের পক্ষে সরকারের দায়িত্ব। পুলিশ মনে করে ক্ষমতাসীনদের রক্ষা করছে পুলিশ, বিনিময়ে শেখ হাসিনা তথা সরকার রক্ষা করছে পুলিশকে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচারে মানুষ মারা বর্তমানে একটি বৈধ লাইসেন্স।

ব্রিটিশের অত্যাচার থেকে বাঁচা এবং নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে পাকিস্তান সৃষ্টির পরও গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলন ও যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ জন্মলাভ করে। রণক্লান্ত জাতিকে একটি সংবিধান উপহার দিয়ে অধিকার রক্ষার একটি রক্ষাকবচ দিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ উপলব্ধির আস্থায় আনার ফলে জাতি হয় আশান্বিত। সংবিধানের তৃতীয় ভাগ ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ের ২৬ থেকে ৪৭ অনুচ্ছেদে নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়। বিশেষ করে সমাবেশের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ ৩৭), সংগঠনের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ ৩৮), চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ ৩৯) নিশ্চয়তা সংবিধান দিয়েছে। কিন্তু সব নিশ্চয়তাই ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের মতো স্বাধীন বাংলাদেশেও নাগরিকদের অধিকার আদায় আজ পুলিশের পায়ের তলায় পিষ্ট। সমাধান কোথায় জানি না, এ জবাব কোথাও পাওয়া যায় না। তাই আজ স্বাদের স্বাধীনতা, হন্য হয়ে তোমাকে খুঁজছি।হ

লেখক  বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা

প্রজন্মনিউজ২৪.কম/মাহমুদুল

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ