ভারতের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা

প্রকাশিত: ৩০ জুলাই, ২০১৭ ০৬:৫১:২৪

ভারতের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা

ভারত প্রেসিডেন্টশাসিত রাষ্ট্র নয়, প্রধানমন্ত্রীশাসিত রাষ্ট্র। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কিছুটা সাংবিধানিক অস্পষ্টতা আছে। ভারতের সংবিধানের ৭৪ নম্বর ধারার ১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা প্রেসিডেন্টকে সর্বদা সাহায্য ও উপদেশ প্রদান করবেন : There shall be a Council of Ministers with the Prime Minister at the head to aid and advise the President in the exercise of his functions। কিন্তু বলা হয়নি আইনত তিনি তা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবেন কি না। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ভারতের প্রেসিডেন্ট জৈল সিংয়ের মতপার্থক্য ঘটেছিল। তখন উঠেছিল এই সাংবিধানিক অস্পষ্টতার কথা। কিন্তু জৈল সিংকে শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আপস করতে হয়।

কেননা ইন্দিরা গান্ধীর ছিল তখন ভারতজুড়ে বিরাট জনপ্রিয়তা। ভারতের প্রেসিডেন্ট ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় লোকসভা ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন দিতে পারেন। কিন্তু আগের ক্ষমতাসীন দল যদি নির্বাচনে জয়ী হয়ে আবার ক্ষমতায় আসে, তবে তারা প্রেসিডেন্টের অপসারণ দাবি করতে পারে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তুলে। তাই বলতে হয়, ভারতের প্রেসিডেন্টের পদ খুব সম্মানীয় হলেও প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা আসলে হলো খুব সীমিত। তাকে চলতে হয় লোকসভার নির্দেশ মেনেই। যেমন বিলাতের রাজা অথবা রানীকে মেনে চলতে হয় বিলাতের পর্লামেন্টের নির্দেশ। ভারতের সংবিধান রচিত হয়েছে বিলাতের উদার গণতন্ত্রের ধ্যানধারণা নির্ভর করে। ভারতীয় গণতন্ত্রে আসলে নেই প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রচিন্তার কোনো প্রভাব।

আমাদের সাংবাদিকেরা মনে হয় অনেকেই ভারতের সংবিধান সম্পর্কে যথাযথ অবগত নন।বাংলাদেশের দৈনিক যুগান্তরের সাংবাদিক লিখেছেন, (২৬ জুলাই ২০১৭) প্রণব মুখোপাধ্যায় ক্ষমতার বৃত্ত থেকে সরে যাওয়ার পর কিছুটা হলেও বাংলাদেশ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল। প্রথম কথা, বাংলাদেশ একটা পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। তার আছে নিজস্ব প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশ চলছে না ভারতের নিয়ন্ত্রণে। প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন ভারতের প্রেসিডেন্ট। তিনি কী করে বাংলাদেশের অভিভাবকত্ব করছিলেন, সেটা ভাবা যায় না। অন্য দিকে ভারতের প্রেসিডেন্ট হলেন নামসর্বস্ব। নিজ দেশেও তিনি কার্যত কোনো ক্ষমতার অধিকারী নন। তিনি নিজের দেশেরও অভিভাবকত্ব করেন না।

প্রণব মুখোপাধ্যায় ভারতের প্রেসিডেন্ট হন মনমোহন সিংয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়। কিন্তু এর পরে ক্ষমতায় আসেন নরেন্দ্র মোদি। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের উচিত ছিল প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দেয়া। কিন্তু তিনি সেটা না করে করেছেন নরেন্দ্র মোদির সহযোগিতা। তাকে তাই বলা চলে না একজন নীতিনিষ্ঠ রাজনীতিবিদ, বরং এ ক্ষেত্রে তার আচরণকে বর্ণনা করতে হয় যথেষ্ট সুবিধাবাদী হিসেবে। অথচ বাংলাদেশে এমন সাংবাদিক আছেন যে, তিনি লিখতে পারেন, প্রণব মুখোপাধ্যায় ভারতের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অবসর নেয়ার ফলে বাংলাদেশ হয়ে পড়ল রাজনৈতিক দিক থেকে অভিভাবকহীন। আমাদের সাংবাদিকতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটা ভাবতে আমাদের লজ্জা পেতে হয়।

আমাদের সাংবাদিকেরা কি ভারতের সংবিধান সম্পর্কে কিছুই অবগত নন? দিল্লিতে যে ভবনে ভারতের প্রেসিডেন্ট থাকেন সেটা একটা বিখ্যাত স্থাপত্যকর্ম। ভবনটি নির্মিত হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলে, গভর্নর জেনারেল থাকার জন্য। কিন্তু এখন সেখানে থাকেন ভারতের প্রেসিডেন্ট। সেটা হয়েছে ভারতের প্রেসিডেন্ট ভবন। এই প্রেসিডেন্ট ভবনের স্থাপত্য পরিকল্পনা করেছিলেন সে সময়ের ব্রিটেনের বিখ্যাত স্থপতি স্যার এডউইন লুটিয়েন্স (Sir Edwin Lutyens)। তার এই স্থাপত্যকর্মে ঘটতে পেরেছে প্রাচ্য ও প্রতিচ্য স্থাপত্যশৈলীর উৎকৃষ্ট সংশ্লেষণ। ভবনটি খুব বিখ্যাত, স্থাপত্যকর্ম হিসেবে। কিন্তু আমাদের সাংবাদিকেরা এই ইতিহাস জানেন না। তারা খুব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রেসিডেন্টের বাসভবন নিয়ে।

তাদের এই উচ্ছ্বাসও আমাকে বিস্মিত করেছে। ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু তাই বলে সবচেয়ে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। সে দিক থেকে এখনো আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট হলেন রাজনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। ১৯৫১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইন প্রণীত হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেউ দুইবারের বেশি অর্থাৎ ৮ বছরের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। কিন্তু ভারতের সংবিধানে বলা হয়নি একজন ব্যক্তি সে দেশের প্রেসিডেন্ট ক’বার হতে পারবেন। প্রণব মুখোপাধ্যায় যদি ইচ্ছা করেন, তবে আবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য যে দাঁড়াতে পারবেন না, তা নয়। কিন্তু মনে হচ্ছে, তিনি আর রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন না।

কেননা, তার দল কংগ্রেস এখন হয়ে পড়েছে খুবই দুর্বল। ভারতের রাজনীতিতে বিজেপি অনেক দিন সবল থাকতে পারবে বলেই বর্তমান পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে। কংগ্রেসের ভোটে জেতার একটা কারণ ছিল মুসলিম ভোটারেরা কংগ্রেসকে ভোট দিত। কিন্তু ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার ফলে ভারতের মুসলিমমানস বিরূপ হয়ে উঠেছে কংগ্রেসের প্রতি। মুসলমানেরা তাই হয়তো চাইবে বিজেপির সাথে আপসরফা করে চলতে। যদিও বিজেপির সাথে তার সঙ্ঘাত বাধছে গরুর গোশত খাওয়া নিয়ে। কিন্তু ভারতে যথেষ্ট তৃণভূমি নেই। বিজেপি বৃদ্ধ গরুকে তাই ঘাস খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। বৃদ্ধ গরু হয়ে উঠবে ঘাসের অভাবে ভারতের একটি বড় সমস্যা। ঘাসের অভাবে যথেষ্ট দুধ দেবে না কম বয়সী গরু।

গো-মাতা হিন্দুদের কাছে পূজনীয়া। ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দুরা করেছিল নিখিল ভারত গো-রক্ষা সমিতি। উত্তর ভারতের নানা জায়গায় সে সময় ঘটেছে Cow killing Riots. যতগুলো কারণে এই উপমহাদেশে পাকিস্তানের দাবি উঠেছিল, তার মধ্যে এই গো-রক্ষা নিয়ে হিন্দু-মুসলমান সঙ্ঘাত ছিল অন্যতম। হিন্দুসমাজ উচ্চবর্ণের ও নিম্নবর্ণের হিন্দুতে বিভক্ত। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে যাদের ধরা হয় সবচেয়ে নিম্নবর্ণ, তাদের এখন বলা হয় দলিত। দলিতদের সংখ্যা এখন হিন্দু জনসমাজের প্রায় শতকরা ১৮ ভাগ। এরা বিবেচিত ছিল এবং এখনো বিবেচিত হয় ম্লেচ্ছ, অচ্ছুত এবং অশুচি হিসেবে। হিন্দু জনসমাজের কাছে মুসলমানেরা সাধারণভাবে বিবেচিত হয়েছে একই রকম ম্লেচ্ছ, অচ্ছুত এবং অশুচি হিসেবে।

খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে বিখ্যাত আরব মুসলিম পরিব্রাজক ইবনে বতুতা মরক্কো থেকে এসেছিলেন বাংলাদেশে। তিনি তার ভ্রমণ-বৃত্তান্তে লিখেছেন, তৃষ্ণার্ত মুসলমান পথিক পান করার জন্য পানি চাইলে, তা প্রদান করে না। কারণ তারা ভাবে, মুসলমানের ছোঁয়ায় তাদের বাসন অপবিত্র হবে। এই উপমহাদেশে পাকিস্তানের দাবি যতগুলো কারণে উঠেছিল, তার মধ্যে সর্ব প্রধান কারণ ছিল মুসলমানদের হিন্দুরা ভেবেছে অপবিত্র মানুষ। ভারতের প্রেসিডেন্ট এখন হলেন একজন হিন্দু দলিত সম্প্রদায়ের ব্যক্তি। তিনি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মতো উচ্চবর্ণের হিন্দু নন। তাই আশা করা যায়, ভারতের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দ হবেন মুসলমানদের প্রতি বেশ কিছুটা সহানুভূতিসম্পন্ন।

ভারতের রাজনীতি আসলে কী রূপ পরিগ্রহ করবে, আমরা তা জানি না। তবে হিন্দু বর্ণবাদ যে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, সেটা অনুমান করতে বাধে না। বিজেপি যদি উগ্র হিন্দুত্ববাদকে প্রশ্রয় দেয়, তবে ভারত এগিয়ে যাবে গৃহযুদ্ধেরই দিকে। মুসলমানরা ভারতে একটা খুব ক্ষুদ্রশক্তি নয়। তারা রাজনৈতিক দিক থেকে হয়ে উঠেছে খুবই সুসংগঠিত। অন্য দিকে দলিতরাও এসে হাত মেলাতে পারে তাদের সাথে। আমাদের দেশের কিছু সংবাদপত্র প্রণব মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে বোধ করছে বিশেষ শ্লাঘা। কেননা, তিনি ছিলেন বাংলাভাষী।

এবং তার স্ত্রী হলেন বাংলাদেশের নড়াইলের কন্যা। যেখানে তার আত্মীয়স্বজন এখনো আছে। কিন্তু প্রণব মুখোপাধ্যায় কোনো দিনই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের পক্ষে ছিলেন না। অন্য কংগ্রেস নেতাদের মতো তিনিও মনে করতেন, বাংলাদেশের উচিত হবে ভারতের একটা প্রদেশে পরিণত হওয়া। তিনি যত দূর জানি, এ কথাই বোঝাতে চান ১৯৭১ সালে এ দেশ থেকে কলকাতায় যাওয়া অনেক আওয়ামী লীগপন্থীকে।

প্রজন্মনিউজ২৪.কম/মাহমুদুল

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ